২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলে বিশাল সমাবেশের ডাক দেয় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। সমাবেশ ঘিরে পুরো মতিঝিল এলাকায় লাখ লাখ হেফাজতকর্মী সমবেত হন সেদিন। তাদের সরাতে রাতে হামলা চালায় পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা। এ সময় সংঘর্ষ হয় দুইপক্ষের।
ওই ঘটনাসহ পরে আরও কিছু ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করে আওয়ামী লীগ সরকার। সম্প্রতি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করে সব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।
শাপলা চত্বরের ঘটনায় সে সময় রাজধানীর চারটি থানায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৪৮টি মামলা দায়ের হয়। ২০১৩ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময় কয়েক দফায় হেফাজতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘাত হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। এসব সংঘাতের জেরে ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও চট্টগ্রাম জেলায় হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মোট ২২০টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮২টি মামলা দায়ের করা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। এছাড়াও ঢাকায় ৭৩টি, নারায়ণগঞ্জে ২৮টি, চট্টগ্রামে ২৬টি ও মুন্সিগঞ্জ জেলায় ১১টি মামলা দায়ের করা হয়। এই পাঁচ জেলার ২৮টি থানায় এই ২২০টি মামলা তৎকালীন আমলে করা হয়। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসব মামলা প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেছে হেফাজতে ইসলাম।
জানা গেছে, ২২০ মামলার মধ্যে ১৬টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব মামলায় হেফাজতে ইসলামের পাশাপাশি বিএনপির অনেক নেতাও আসামি ছিলেন। প্রত্যাহার হওয়া এসব মামলার মধ্যে রাজধানীর পল্টন ও মিরপুর মডেল থানার চারটি করে আটটি, মতিঝিল থানার পাঁচটি, শাহবাগ থানার দুইটি এবং দারুস সালাম থানার একটি মামলা রয়েছে।
পাঁচ জেলায় হেফাজতের বিরুদ্ধে হওয়া মোট ২২০টি মামলার মধ্যে ৪৮টি দায়ের করা হয় শাপলা চত্বরের সংঘর্ষের ঘটনায়। আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর সম্প্রতি শাপলা চত্বরের ২৫ টি মামলায় আনীত অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে সব আসামির অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে ২১টি মামলা তদন্তধীন ও দুটি মামলায় স্থগিতাদেশ রয়েছে।
আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখা সূত্রে জানা গেছে, হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরের ঘটনায় ৪৮টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয় পল্টন মডেল থানায়। এ থানায় হওয়া মামলার সংখ্যা ৩৬টি। এসব মামলার মধ্যে ২২টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। অপর ১৪টি তদন্তাধীন রয়েছে। মতিঝিল থানায় হওয়া ছয়টি মামলার মধ্যে দুইটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। অপর দুটি তদন্তাধীন ও দুটি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। রমনা মডেল থানার দুই মামলার মধ্যে একটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা হয়েছে, অপর মামলাটি তদন্তাধীন। এছাড়া শাহবাগ থানার চার মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। জানা গেছে, আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসব মামলা নিষ্পত্তি বা প্রত্যাহারের বিষয় প্রক্রিয়াধীন থাকায় কিছুটা সময় লাগছে।
এ প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম হিমেল বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। নেতাকর্মীদের হত্যা করে উল্টো তাদের নামেই মামলা দায়ের করে পুলিশ। গত ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এসব মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত করে পুলিশ। তদন্তে অভিযুক্ত হেফাজতে ইসলাম, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এ জন্যই সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা আদালতে আসামিদের অব্যাহতির সুপারিশ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। এছাড়া এখনো অনেক মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। এজন্য হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে সেগুলো প্রত্যাহার চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী আইনবিষয়ক সম্পাদক শরীফ হুসাইন বলেন, শাপলা চত্বরে আমরা রাসুল (সা.)-কে অবমাননার বিচার চাইতে গেছিলাম। কিন্তু বিচারের বদলে পেলাম গুলি, লাশ আর মিথ্যা মামলা। এখন স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। এজন্য পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারছে। ফলে হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, এই মামলাগুলো রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় তদন্ত শেষে অনেক মামলায় আসামিদের অব্যাহতির সুপারিশ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ। এখনো কিছু মামলা তদন্তধীন। সেগুলো তদন্ত সাপেক্ষে নিষ্পত্তি করা হবে।
এদিকে, গত ১৮ আগস্ট রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে গণহত্যার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) মো. জাকী-আল-ফারাবীর আদালতে এ মামলার আবেদন করেন বাংলাদেশ পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারী। আদালত মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। এছাড়া গত ২৬ নভেম্বর গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছে হেফাজতে ইসলাম। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫০ জনকে অভিযুক্ত করে এই মামলা দায়ের করেন তারা।