ঢাকা , মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের চিহ্ন বহন করছে কাশ্মীর সীমান্তের পরিবারগুলো

১৬ বছর বয়সী নিমরার ঘুমটা ভেঙ্গে যায় একটা ভারতীয় মিসাইলের শব্দে। বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। পা যেন আর নড়ছিল না নিমরার। পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে নিমরাদের বাড়ির কয়েক মিটার দূরের মসজিদে ততক্ষণে আঘাত করেছে ভারতীয় মিসাইল। চোখের সামনেই সে দেখেছিল মিসাইলের আঘাতে মসজিদের একটা মিনার ভেঙ্গে পড়েছে। আঘাত যে ওর নিজের বুকেও লেগেছে, সেটা বুঝতেই পারেনি নিমরা।

ওর পরিবারের লোকজন কাছেই ওর খালার বাড়িতে পৌঁছনোর পরে কেউ একজন ফোনের টর্চ জ্বালিয়েছিল। নিমরা বলে, আমার খালা তো আঁতকিয়ে উঠেছিল। আমার জামায় তখন রক্ত। আসলে জামার রং ছিল সাদা আর গোলাপী, কিন্তু ততক্ষণে জামাটা যেন কেউ লাল রঙে চুবিয়ে দিয়েছে। আমি আগে কখনও দেখিনি এরকম।

সে সময় সবাই দৌড়াতে শুরু করে। নিমরা বলে, আমিও দৌড়চ্ছিলাম, কিন্তু পুরো সময়টা বুকে একটা হাত চেপে রেখেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল হাতটা সরালেই ভেতর থেকে সবকিছু বেরিয়ে আসবে।

পরে জানা গিয়েছিল যে ওর হৃদপিণ্ডের খুব কাছে একটা ধারালো টুকরো গেঁথে গেছে। এর কয়েক ঘণ্টা পরে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে পাকিস্তান যে গোলাবর্ষণ শুরু করেছিল, তা থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুঞ্চের অন্য একটি পরিবার।

যখন গোলাগুলি শুরু হয়, তখন সবাই প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াচ্ছিল- শিশুরা ভয়ে তাদের বাবা-মাকে আঁকড়ে ধরে ছিল বলে জানান ৭২ বছর বয়সী এমএন সুধান।

তিনি বলেন, কয়েকটি পরিবার গাড়িতে করে জম্মুর উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম পালিয়ে যাব। কিন্তু আমরা রওনা হওয়ার মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে একটি গোলা এসে পড়লো আমাদের গাড়ির খুব কাছে। ধারালো টুকরোগুলো গাড়ির ভেতরে ছিটকে এসেছিল। আমার নাতি ওখানেই মারা যায়।

আমাদের ভবিষ্যতটা তখনই তছনছ হয়ে গেছে- ১৩ বছরের বিহান মারা যাওয়ার কথা মনে করে বলছিলেন তার দাদু। তিনি বলেন, আমরা তো সব হারালাম, দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর তো কিছুই রইল না আমাদের। আমি ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে দুটি যুদ্ধ দেখেছি, কিন্তু এত তীব্র গোলাবর্ষণ আগে কখনও দেখিনি।

গোলাগুলির মাঝে পড়ে গেলাম

ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক তীব্রতম সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গিয়েছেন কাশ্মীর সীমান্তের পরিবারগুলো। বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার কথা অস্বীকার করেছে দুদেশের সরকারই। কিন্তু ওই অঞ্চলে সংঘর্ষের মাঝে পড়ে যাওয়া পরিবারগুলোর খোঁজ নিয়েছেন বিবিসির সংবাদদাতারা।

কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখার দুদিকেই অনেক মানুষই বিবিসিকে জানিয়েছেন যে, তাদের প্রিয়জনকে যেমন হারাতে হয়েছে, তেমনই সম্পদেরও ক্ষতি হয়েছে। ভারতের দিকে অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে আর পাকিস্তান দাবি করেছে যে, তাদের ৪০ জন বেসামরিক মানুষের প্রাণ গেছে। তবে এটা নিশ্চিত করা যায়নি যে সরাসরি গোলার আঘাতে ঠিক কতজন মারা গেছেন।

বিহানের দাদু সুধান বলেন, আগে থেকে তো সতর্ক করা হয়নি যে, বাড়ির ভেতরে থাকতে হবে বা এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। আগে থেকে কেন আমাদের জানানো হলো না? আমরা সাধারণ মানুষরা তো গোলাগুলির মাঝে পড়ে গেলাম।

ভারত সরকার সম্ভবত আগে থেকে সাধারণ মানুষকে এলাকা খালি করতে বলেনি এ কারণে যাতে সামরিক হামলার বিষয়টা গোপন রাখা যায়। তবে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা কিন্তু এপ্রিল মাসে পহেলগামের হত্যাকাণ্ডের পরেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে সাধারণ মানুষকে গ্রামের বাঙ্কারগুলো পরিষ্কার করে রাখতে বলেছিলেন।

ভারত যেদিন প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়লো অর্থাৎ গত ৭ মের পরের দিনই দুই দেশেই ড্রোন হামলা শুরু হয়। এরপরেই নিয়ন্ত্রণ রেখার ভারতের দিক থেকে হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে দিতে শুরু করে সরকার। সেদিনই রাত ৯টার দিকে ভারত শাসিত কাশ্মীরের উরির বাসিন্দা খান পরিবার ঠিক করে যে তাদেরও বাড়ি ছাড়তে হবে। বেশিরভাগ প্রতিবেশীই ততক্ষণে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় একটি গোলা থেকে ছুটে আসা ধাতব টুকরো ৪৭ বছরের নার্গিসের গায়ে বিঁধে যায়। তার আরেক আত্মীয় হাফিজাও গুরুতর আহত হন। গাড়ি নিয়ে তারা সোজা চলে যায় কাছের হাসপাতালে। কিন্তু দেখা যায় হাসপাতালের দরজায় তালা দেওয়া।

হাফিজা বলেন, আমি কোনমতে হাসপাতালের পাঁচিল টপকিয়ে ভেতরে গিয়ে সাহায্য চাই। ওদের বলি যে আমাদের সঙ্গে আহত মানুষ আছেন। তখন একজন এসে দরজা খোলে। গোলাবর্ষণের ফলে ডাক্তাররা ভয় পেয়ে গিয়ে সব বন্ধ করে ভেতরে বসেছিলেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।

জামা-কাপড় মায়ের রক্তে ভেসে যাচ্ছিল

নার্গিসের ছয় সন্তান। তার সবচেয়ে ছোট মেয়ে ২০ বছরের সানাম বলেন, প্রথমে যে হাসপাতালটায় তারা গিয়েছিলেন, সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। আরেকটি হাসপাতালে তার মাকে নিয়ে যাওয়ার পথেই তিনি মারা যান।

তিনি বলেন, গোলা থেকে ছিটকে আসা একটা টুকরো মায়ের মুখে বিঁধেছিল। আমার জামাকাপড় মায়ের রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। আমরা সমানে মায়ের সঙ্গে কথা বলে চলেছিলাম যাতে মায়ের জ্ঞান থাকে। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না।

ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে ২০২১ সালের যুদ্ধ বিরতির পর থেকে ওই অঞ্চলে মানুষ বেশ শান্তিতেই থাকছিলেন। অনেক বছর পর তারা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে শুরু করেছিলেন। তবে তাদের সেই নিরাপদে থাকাটা এখন অতীত।

সানাম বলেন, আমি দুই সরকারের কাছেই অনুরোধ করবো যে, আপনারা যদি যুদ্ধ করবেন বলে ঠিক করেন, তাহলে অন্তত বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা দিন, তাদের তৈরি হওয়ার সময় দিন।

তিনি বলেন, যারা আরামে বসে যুদ্ধ চায় তাদের সীমান্তে পাঠানো হোক। তারা দেখে যান এখানে কেমন করে জীবন কাটে আমাদের। তাদের নিজেদের চোখের সামনে প্রিয়জনকে হারালে তারা টের পাবেন।

এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল, পরের মুহূর্তেই নেই

ভারত হামলা চালিয়েছে এটা জানার পরেই ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি অঞ্চলের বিধায়ক সাজ্জাদ শফি এলাকার মানুষকে সরিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। তবে সরে যাওয়ার সময়টা পাননি নিয়ন্ত্রণ রেখার অন্যদিকে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের নীলম উপত্যকার বাসিন্দা মুহাম্মদ শফি।

৩০ বছর বয়সী মুহাম্মদ শফি শাহকোট গ্রামে তার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সামনেই খেলছিল তার ছেলে। উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার স্ত্রী। তিনি বলেন, হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা মর্টার শেল ছুটে আসছে। চোখের পলকে শেলটা আমার স্ত্রীর গায়ে এসে পড়ল। চিৎকার করার সময়টাও পায়নি ও। এই এখানে দাঁড়িয়ে ছিল, পরের মুহূর্তেই নেই। তার মুখ, মাথা- কিচ্ছু ছিল না। শুধু কিছুটা ধোঁয়া আর ধুলো। আমার কানের পর্দায় তালা লেগে গিয়েছিল। কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি বুঝতেও পারিনি যে আমি ভীষণ জোর চিৎকার করছিলাম।

তিনি বলেন, ওই রাতে স্ত্রীর দেহের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা নিয়ে আমি ঘরেই ছিলাম। পুরো গ্রামের সবাই বাঙ্কারে চলে গিয়েছিল। রাতভর গোলা পড়েছে, আর আমি স্ত্রীর দেহ নিয়ে কেঁদেই চলছিলাম। যতক্ষণ পেরেছি ওর হাতটা ধরে রেখেছিলাম।

একটি বাঙ্কারে তার ভাতিজি ১৮ বছর বয়সী উমাইমাও ছিল। ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে চারদিন তাকে এবং তার পরিবারকে বাঙ্কারে কাটাতে হয়েছে। একটা বাঙ্কারে আমরা ৬-৭ জন গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। অন্য বাঙ্কারটা তখন ভর্তি হয়ে গেছে। বাঙ্কারের ভেতরে শোওয়ার জায়গাও ছিল না। কেউ দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ বসে ছিল। খাবার বা পানি ছিল না। ঘোর অন্ধকারের মধ্যে সবাই ভয়ে চিৎকার করছিল, কাঁদছিল, কেউ আল্লাহকে ডাকছিল বলে জানান তিনি।

পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের যে এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি সমরসজ্জায় সজ্জিত ও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, তারই অন্যতম লিপা উপত্যকা। সেখানকার একটি বাঙ্কারে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন শামস উর রহমান। বাঙ্কারটি রহমানের নিজস্ব, তবে সে রাতে তিনি আরও ৩৬ জনকে সেখানে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

লিপা উপত্যকার তিন দিকেই নিয়ন্ত্রণরেখা আর ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর। সীমান্ত অঞ্চলের উত্তেজনার মধ্যে বসবাস করা রহমানের অভ্যাস আছে। কিন্তু তিনি কল্পনাও করেননি যে তার বাড়িটা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। চারপাশের অবস্থা দেখতে ভোর তিনটার দিকে তিনি বাঙ্কারের বাইরে বেরিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, সব শেষ হয়ে গেল। বাড়ির কাঠের তক্তাগুলো আর ধ্বংসাবশেষ চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বিস্ফোরণটা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে বাড়ির ভিতটাও কেঁপে ওঠে। ছাদের টিন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। পুরো বাড়িটাই অন্তত দুই ইঞ্চি সরে গেছে।

তিনি বলেন, একটা বাড়ি বানাতে সারা জীবন লেগে যায়। সবারই চেষ্টা থাকে কী করে আরও একটু ভালো করা যায় বাড়িটা, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তো পুরো ভেঙ্গে পড়ল।

অপরদিকে নীলম উপত্যকার উমাইমা ও তার পরিবার চার ঘণ্টা পরে শনিবার ১০ মে বাঙ্কার থেকে বাইরে এসে দেখেন যে, চারপাশটা পুরো বদলে গেছে। তিনি বলেন, আমরা সকাল ৭টায় বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসি। তখনই আমরা দেখলাম কিছুই অবশিষ্ট নেই।

আগামীতে অন্য কেউ তার প্রিয়জনকে হারাবে

উমাইমা যখন তার গ্রামের ধ্বংসস্তুপগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন, সেদিনই ভারত আর পাকিস্তানের দুই সামরিক বাহিনী একে অপরের সামরিক স্থাপনাগুলোতে মিসাইল দিয়ে হামলা চালায়।

পাকিস্তানের যে তিনটি বিমান ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায় ভারত, তার মধ্যে অন্যতম ছিল রাওয়ালপিন্ডির বিমান ঘাঁটিও। ওই শহরেই পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তর অবস্থিত। এক পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা বলেন, সীমারেখাটা সেদিনই অতিক্রম করা হয়েছিল। পাল্টা জবাবে পাকিস্তান ভারতীয় সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল। অন্যদিকে কূটনৈতিক স্তরে চলছিল চূড়ান্ত ব্যস্ততা।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, একের পর এক বৈঠক, সমন্বয়, নানা দেশ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এবং তারপরে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করা হচ্ছে, তারাও আবার ফোনে কথা বলছেন অন্য দেশের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব বা ইরান – যে কোনো দেশই মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিলে আমরা স্বাগত জানাই যাতে উত্তেজনা প্রশমন করা যায়।

গত ২২ এপ্রিল পহেলগামে হামলার পর থেকেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর অন্তত ১৭ জন বিশ্ব নেতা এবং কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলেছেন। এর মধ্যে ছিলেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ।

এসব আলোচনা নিয়ে জয়শঙ্কর যেসব টুইট করেছেন, তাতে তিনি জানিয়েছিলেন সীমান্ত পারের উগ্রপন্থী হামলা’র ওপরে যেমন জোর দেওয়া হয়েছে, তেমনই পহেলগামের হামলার মূল চক্রীদের নির্দিষ্টভাবে দায়ী করতে চেষ্টা চালানো হয়েছে।

দুই তরফে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরেই সেই শনিবার বিকেলেই কূটনৈতিক সাফল্য আসে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে দুদেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, পর্দার আড়ালে মার্কিন মধ্যস্থতাকারী এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরবসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কূটনৈতিক মধ্যস্থতা উত্তেজনা প্রশমনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

ভারতের এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, আমরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অনেকটা ভেতরে সেদেশের কৌশলগত স্থাপনাগুলোতে আঘাত করতে পেরেছি দেখেই সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল।

দুই দেশের এই সর্বশেষ সামরিক অভিযানের শুরুটা যেখানে, সেই পহেলগামের হামলাকারীদের খোঁজ এখনও চলছে। পহেলগামে হামলায় নিহত ভারতীয় নৌবাহিনীর ২৬ বছর বয়সী কর্মকর্তা বিনয় নারওয়াল সেখানে গিয়েছিলেন মধুচন্দ্রিমায়। হামলার মাত্র এক সপ্তাহ আগে তিনি বিয়ে করেছিলেন।

হামলার পর নারওয়ালের স্ত্রী হিমাংশী স্বামীর দেহের পাশে বসে আছেন, এমন একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয়। নারওয়ালের দাদা হাওয়া সিং হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন।

তিনি বলেন, এই সন্ত্রাসের অবসান হওয়া উচিত। আজ আমি আমার নাতিকে হারালাম। আগামীতে অন্য কেউ তার প্রিয়জনকে হারাবে। ছবির মতো সুন্দর কাশ্মীরে পর্যটন নিয়ে সরকার যে ব্যাপক প্রচার করছিল, তার মধ্যেই পহেলগামের ওই হামলা ভারতের সরকারকে প্রবল ধাক্কার মুখে ফেলে দিয়েছে।

ভারত সরকারের একটি সূত্র বলছে, কাশ্মীর নিয়ে পর্যটকদের উৎসাহ দেখে আমরা বোধহয় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলাম। আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম যে চড়াইটা পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু আমরা ভুল ভেবেছিলাম। চার দিনের এই সংঘাত আবারও দেখিয়ে দিলো যে, দুই দেশের মধ্যে শান্তি কতটা ভঙ্গুর হতে পারে।

ট্যাগস

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের চিহ্ন বহন করছে কাশ্মীর সীমান্তের পরিবারগুলো

আপডেট সময় ৯ ঘন্টা আগে

১৬ বছর বয়সী নিমরার ঘুমটা ভেঙ্গে যায় একটা ভারতীয় মিসাইলের শব্দে। বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল সে। পা যেন আর নড়ছিল না নিমরার। পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে নিমরাদের বাড়ির কয়েক মিটার দূরের মসজিদে ততক্ষণে আঘাত করেছে ভারতীয় মিসাইল। চোখের সামনেই সে দেখেছিল মিসাইলের আঘাতে মসজিদের একটা মিনার ভেঙ্গে পড়েছে। আঘাত যে ওর নিজের বুকেও লেগেছে, সেটা বুঝতেই পারেনি নিমরা।

ওর পরিবারের লোকজন কাছেই ওর খালার বাড়িতে পৌঁছনোর পরে কেউ একজন ফোনের টর্চ জ্বালিয়েছিল। নিমরা বলে, আমার খালা তো আঁতকিয়ে উঠেছিল। আমার জামায় তখন রক্ত। আসলে জামার রং ছিল সাদা আর গোলাপী, কিন্তু ততক্ষণে জামাটা যেন কেউ লাল রঙে চুবিয়ে দিয়েছে। আমি আগে কখনও দেখিনি এরকম।

সে সময় সবাই দৌড়াতে শুরু করে। নিমরা বলে, আমিও দৌড়চ্ছিলাম, কিন্তু পুরো সময়টা বুকে একটা হাত চেপে রেখেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল হাতটা সরালেই ভেতর থেকে সবকিছু বেরিয়ে আসবে।

পরে জানা গিয়েছিল যে ওর হৃদপিণ্ডের খুব কাছে একটা ধারালো টুকরো গেঁথে গেছে। এর কয়েক ঘণ্টা পরে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে পাকিস্তান যে গোলাবর্ষণ শুরু করেছিল, তা থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুঞ্চের অন্য একটি পরিবার।

যখন গোলাগুলি শুরু হয়, তখন সবাই প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াচ্ছিল- শিশুরা ভয়ে তাদের বাবা-মাকে আঁকড়ে ধরে ছিল বলে জানান ৭২ বছর বয়সী এমএন সুধান।

তিনি বলেন, কয়েকটি পরিবার গাড়িতে করে জম্মুর উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম পালিয়ে যাব। কিন্তু আমরা রওনা হওয়ার মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে একটি গোলা এসে পড়লো আমাদের গাড়ির খুব কাছে। ধারালো টুকরোগুলো গাড়ির ভেতরে ছিটকে এসেছিল। আমার নাতি ওখানেই মারা যায়।

আমাদের ভবিষ্যতটা তখনই তছনছ হয়ে গেছে- ১৩ বছরের বিহান মারা যাওয়ার কথা মনে করে বলছিলেন তার দাদু। তিনি বলেন, আমরা তো সব হারালাম, দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর তো কিছুই রইল না আমাদের। আমি ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে দুটি যুদ্ধ দেখেছি, কিন্তু এত তীব্র গোলাবর্ষণ আগে কখনও দেখিনি।

গোলাগুলির মাঝে পড়ে গেলাম

ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক তীব্রতম সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গিয়েছেন কাশ্মীর সীমান্তের পরিবারগুলো। বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার কথা অস্বীকার করেছে দুদেশের সরকারই। কিন্তু ওই অঞ্চলে সংঘর্ষের মাঝে পড়ে যাওয়া পরিবারগুলোর খোঁজ নিয়েছেন বিবিসির সংবাদদাতারা।

কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখার দুদিকেই অনেক মানুষই বিবিসিকে জানিয়েছেন যে, তাদের প্রিয়জনকে যেমন হারাতে হয়েছে, তেমনই সম্পদেরও ক্ষতি হয়েছে। ভারতের দিকে অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে আর পাকিস্তান দাবি করেছে যে, তাদের ৪০ জন বেসামরিক মানুষের প্রাণ গেছে। তবে এটা নিশ্চিত করা যায়নি যে সরাসরি গোলার আঘাতে ঠিক কতজন মারা গেছেন।

বিহানের দাদু সুধান বলেন, আগে থেকে তো সতর্ক করা হয়নি যে, বাড়ির ভেতরে থাকতে হবে বা এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। আগে থেকে কেন আমাদের জানানো হলো না? আমরা সাধারণ মানুষরা তো গোলাগুলির মাঝে পড়ে গেলাম।

ভারত সরকার সম্ভবত আগে থেকে সাধারণ মানুষকে এলাকা খালি করতে বলেনি এ কারণে যাতে সামরিক হামলার বিষয়টা গোপন রাখা যায়। তবে স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারা কিন্তু এপ্রিল মাসে পহেলগামের হত্যাকাণ্ডের পরেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে সাধারণ মানুষকে গ্রামের বাঙ্কারগুলো পরিষ্কার করে রাখতে বলেছিলেন।

ভারত যেদিন প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়লো অর্থাৎ গত ৭ মের পরের দিনই দুই দেশেই ড্রোন হামলা শুরু হয়। এরপরেই নিয়ন্ত্রণ রেখার ভারতের দিক থেকে হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে দিতে শুরু করে সরকার। সেদিনই রাত ৯টার দিকে ভারত শাসিত কাশ্মীরের উরির বাসিন্দা খান পরিবার ঠিক করে যে তাদেরও বাড়ি ছাড়তে হবে। বেশিরভাগ প্রতিবেশীই ততক্ষণে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় একটি গোলা থেকে ছুটে আসা ধাতব টুকরো ৪৭ বছরের নার্গিসের গায়ে বিঁধে যায়। তার আরেক আত্মীয় হাফিজাও গুরুতর আহত হন। গাড়ি নিয়ে তারা সোজা চলে যায় কাছের হাসপাতালে। কিন্তু দেখা যায় হাসপাতালের দরজায় তালা দেওয়া।

হাফিজা বলেন, আমি কোনমতে হাসপাতালের পাঁচিল টপকিয়ে ভেতরে গিয়ে সাহায্য চাই। ওদের বলি যে আমাদের সঙ্গে আহত মানুষ আছেন। তখন একজন এসে দরজা খোলে। গোলাবর্ষণের ফলে ডাক্তাররা ভয় পেয়ে গিয়ে সব বন্ধ করে ভেতরে বসেছিলেন। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।

জামা-কাপড় মায়ের রক্তে ভেসে যাচ্ছিল

নার্গিসের ছয় সন্তান। তার সবচেয়ে ছোট মেয়ে ২০ বছরের সানাম বলেন, প্রথমে যে হাসপাতালটায় তারা গিয়েছিলেন, সেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। আরেকটি হাসপাতালে তার মাকে নিয়ে যাওয়ার পথেই তিনি মারা যান।

তিনি বলেন, গোলা থেকে ছিটকে আসা একটা টুকরো মায়ের মুখে বিঁধেছিল। আমার জামাকাপড় মায়ের রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। আমরা সমানে মায়ের সঙ্গে কথা বলে চলেছিলাম যাতে মায়ের জ্ঞান থাকে। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না।

ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে ২০২১ সালের যুদ্ধ বিরতির পর থেকে ওই অঞ্চলে মানুষ বেশ শান্তিতেই থাকছিলেন। অনেক বছর পর তারা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে শুরু করেছিলেন। তবে তাদের সেই নিরাপদে থাকাটা এখন অতীত।

সানাম বলেন, আমি দুই সরকারের কাছেই অনুরোধ করবো যে, আপনারা যদি যুদ্ধ করবেন বলে ঠিক করেন, তাহলে অন্তত বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা দিন, তাদের তৈরি হওয়ার সময় দিন।

তিনি বলেন, যারা আরামে বসে যুদ্ধ চায় তাদের সীমান্তে পাঠানো হোক। তারা দেখে যান এখানে কেমন করে জীবন কাটে আমাদের। তাদের নিজেদের চোখের সামনে প্রিয়জনকে হারালে তারা টের পাবেন।

এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল, পরের মুহূর্তেই নেই

ভারত হামলা চালিয়েছে এটা জানার পরেই ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি অঞ্চলের বিধায়ক সাজ্জাদ শফি এলাকার মানুষকে সরিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। তবে সরে যাওয়ার সময়টা পাননি নিয়ন্ত্রণ রেখার অন্যদিকে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের নীলম উপত্যকার বাসিন্দা মুহাম্মদ শফি।

৩০ বছর বয়সী মুহাম্মদ শফি শাহকোট গ্রামে তার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। সামনেই খেলছিল তার ছেলে। উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার স্ত্রী। তিনি বলেন, হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা মর্টার শেল ছুটে আসছে। চোখের পলকে শেলটা আমার স্ত্রীর গায়ে এসে পড়ল। চিৎকার করার সময়টাও পায়নি ও। এই এখানে দাঁড়িয়ে ছিল, পরের মুহূর্তেই নেই। তার মুখ, মাথা- কিচ্ছু ছিল না। শুধু কিছুটা ধোঁয়া আর ধুলো। আমার কানের পর্দায় তালা লেগে গিয়েছিল। কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি বুঝতেও পারিনি যে আমি ভীষণ জোর চিৎকার করছিলাম।

তিনি বলেন, ওই রাতে স্ত্রীর দেহের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা নিয়ে আমি ঘরেই ছিলাম। পুরো গ্রামের সবাই বাঙ্কারে চলে গিয়েছিল। রাতভর গোলা পড়েছে, আর আমি স্ত্রীর দেহ নিয়ে কেঁদেই চলছিলাম। যতক্ষণ পেরেছি ওর হাতটা ধরে রেখেছিলাম।

একটি বাঙ্কারে তার ভাতিজি ১৮ বছর বয়সী উমাইমাও ছিল। ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে চারদিন তাকে এবং তার পরিবারকে বাঙ্কারে কাটাতে হয়েছে। একটা বাঙ্কারে আমরা ৬-৭ জন গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। অন্য বাঙ্কারটা তখন ভর্তি হয়ে গেছে। বাঙ্কারের ভেতরে শোওয়ার জায়গাও ছিল না। কেউ দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ বসে ছিল। খাবার বা পানি ছিল না। ঘোর অন্ধকারের মধ্যে সবাই ভয়ে চিৎকার করছিল, কাঁদছিল, কেউ আল্লাহকে ডাকছিল বলে জানান তিনি।

পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের যে এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি সমরসজ্জায় সজ্জিত ও সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, তারই অন্যতম লিপা উপত্যকা। সেখানকার একটি বাঙ্কারে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন শামস উর রহমান। বাঙ্কারটি রহমানের নিজস্ব, তবে সে রাতে তিনি আরও ৩৬ জনকে সেখানে আশ্রয় দিয়েছিলেন।

লিপা উপত্যকার তিন দিকেই নিয়ন্ত্রণরেখা আর ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর। সীমান্ত অঞ্চলের উত্তেজনার মধ্যে বসবাস করা রহমানের অভ্যাস আছে। কিন্তু তিনি কল্পনাও করেননি যে তার বাড়িটা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। চারপাশের অবস্থা দেখতে ভোর তিনটার দিকে তিনি বাঙ্কারের বাইরে বেরিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, সব শেষ হয়ে গেল। বাড়ির কাঠের তক্তাগুলো আর ধ্বংসাবশেষ চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বিস্ফোরণটা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে বাড়ির ভিতটাও কেঁপে ওঠে। ছাদের টিন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। পুরো বাড়িটাই অন্তত দুই ইঞ্চি সরে গেছে।

তিনি বলেন, একটা বাড়ি বানাতে সারা জীবন লেগে যায়। সবারই চেষ্টা থাকে কী করে আরও একটু ভালো করা যায় বাড়িটা, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তো পুরো ভেঙ্গে পড়ল।

অপরদিকে নীলম উপত্যকার উমাইমা ও তার পরিবার চার ঘণ্টা পরে শনিবার ১০ মে বাঙ্কার থেকে বাইরে এসে দেখেন যে, চারপাশটা পুরো বদলে গেছে। তিনি বলেন, আমরা সকাল ৭টায় বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে আসি। তখনই আমরা দেখলাম কিছুই অবশিষ্ট নেই।

আগামীতে অন্য কেউ তার প্রিয়জনকে হারাবে

উমাইমা যখন তার গ্রামের ধ্বংসস্তুপগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন, সেদিনই ভারত আর পাকিস্তানের দুই সামরিক বাহিনী একে অপরের সামরিক স্থাপনাগুলোতে মিসাইল দিয়ে হামলা চালায়।

পাকিস্তানের যে তিনটি বিমান ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায় ভারত, তার মধ্যে অন্যতম ছিল রাওয়ালপিন্ডির বিমান ঘাঁটিও। ওই শহরেই পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তর অবস্থিত। এক পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা বলেন, সীমারেখাটা সেদিনই অতিক্রম করা হয়েছিল। পাল্টা জবাবে পাকিস্তান ভারতীয় সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল। অন্যদিকে কূটনৈতিক স্তরে চলছিল চূড়ান্ত ব্যস্ততা।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, একের পর এক বৈঠক, সমন্বয়, নানা দেশ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এবং তারপরে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করা হচ্ছে, তারাও আবার ফোনে কথা বলছেন অন্য দেশের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব বা ইরান – যে কোনো দেশই মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিলে আমরা স্বাগত জানাই যাতে উত্তেজনা প্রশমন করা যায়।

গত ২২ এপ্রিল পহেলগামে হামলার পর থেকেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর অন্তত ১৭ জন বিশ্ব নেতা এবং কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলেছেন। এর মধ্যে ছিলেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ।

এসব আলোচনা নিয়ে জয়শঙ্কর যেসব টুইট করেছেন, তাতে তিনি জানিয়েছিলেন সীমান্ত পারের উগ্রপন্থী হামলা’র ওপরে যেমন জোর দেওয়া হয়েছে, তেমনই পহেলগামের হামলার মূল চক্রীদের নির্দিষ্টভাবে দায়ী করতে চেষ্টা চালানো হয়েছে।

দুই তরফে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরেই সেই শনিবার বিকেলেই কূটনৈতিক সাফল্য আসে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে দুদেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, পর্দার আড়ালে মার্কিন মধ্যস্থতাকারী এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরবসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোর কূটনৈতিক মধ্যস্থতা উত্তেজনা প্রশমনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

ভারতের এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, আমরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অনেকটা ভেতরে সেদেশের কৌশলগত স্থাপনাগুলোতে আঘাত করতে পেরেছি দেখেই সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল।

দুই দেশের এই সর্বশেষ সামরিক অভিযানের শুরুটা যেখানে, সেই পহেলগামের হামলাকারীদের খোঁজ এখনও চলছে। পহেলগামে হামলায় নিহত ভারতীয় নৌবাহিনীর ২৬ বছর বয়সী কর্মকর্তা বিনয় নারওয়াল সেখানে গিয়েছিলেন মধুচন্দ্রিমায়। হামলার মাত্র এক সপ্তাহ আগে তিনি বিয়ে করেছিলেন।

হামলার পর নারওয়ালের স্ত্রী হিমাংশী স্বামীর দেহের পাশে বসে আছেন, এমন একটি ছবি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয়। নারওয়ালের দাদা হাওয়া সিং হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন।

তিনি বলেন, এই সন্ত্রাসের অবসান হওয়া উচিত। আজ আমি আমার নাতিকে হারালাম। আগামীতে অন্য কেউ তার প্রিয়জনকে হারাবে। ছবির মতো সুন্দর কাশ্মীরে পর্যটন নিয়ে সরকার যে ব্যাপক প্রচার করছিল, তার মধ্যেই পহেলগামের ওই হামলা ভারতের সরকারকে প্রবল ধাক্কার মুখে ফেলে দিয়েছে।

ভারত সরকারের একটি সূত্র বলছে, কাশ্মীর নিয়ে পর্যটকদের উৎসাহ দেখে আমরা বোধহয় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলাম। আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম যে চড়াইটা পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু আমরা ভুল ভেবেছিলাম। চার দিনের এই সংঘাত আবারও দেখিয়ে দিলো যে, দুই দেশের মধ্যে শান্তি কতটা ভঙ্গুর হতে পারে।