শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সমবায় অধিদপ্তরের উপ-নিবন্ধক ও আলোচিত শেয়ার ব্যবসায়ী মো. আবুল খায়ের হিরু এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ডজন খানেকের বেশি কোম্পানির শেয়ার কারসাজি করে মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে তাদের মোট ২০৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের দায়ে আবুল খায়ের হিরুকে এই অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিএসইসি গত ১৩ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে অবহিত করেছে। একই সঙ্গে বিষয়টি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব, সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকেও জানানো হয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগেও ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর একই বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বরাবর চিঠি পাঠিয়েছিল বিএসইসি।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কঠোর বিএসইসি
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আবুল খায়ের হিরু, তার পরিবারের সদস্য এবং সহযোগীদের বিরুদ্ধে শেয়ার কারসাজির অভিযোগ উঠলেও তেমন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিএসইসি’র পুনর্গঠিত খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন আবুল খায়ের হিরু ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। এমনকি, আবুল খায়েরের ব্যবসায়িক পার্টনার বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানকেও এই কারসাজির ঘটনায় ছাড় দেয়নি বিএসইসি।
বিএসইসি’র চিঠিতে যা উল্লেখ রয়েছে
অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বিএসইসি উল্লেখ করেছে যে, আবুল খায়ের হিরু একজন সরকারি কর্মচারী এবং সমবায় অধিদপ্তরে উপ-নিবন্ধক হিসেবে কর্মরত। তিনি নিজে এবং তার সহযোগীদের সঙ্গে মিলিতভাবে বিভিন্ন সময়ে শেয়ারবাজারে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার লেনদেনে কারসাজি করেছেন। এই কারসাজির ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যা শেয়ারবাজার উন্নয়নের পরিপন্থী। তার এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন প্রমাণিত হওয়ায় বিএসইসি তাদের বিভিন্ন সময়ে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করেছে।
জরিমানা ও জড়িতদের তালিকা
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ১৯ জুন থেকে ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত আবুল খায়ের হিরু ও তার সহযোগীদের ১৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ৭ মে পর্যন্ত ১৯৪ কোটি ৬ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, সর্বমোট জরিমানার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই পদক্ষেপ শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিএসইসি’র প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু শেয়ার কারসাজির ঘটনা ও জরিমানা
১. ২০২২ সালের ১৯ জুন
গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স ও ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান ও তাদের সহযোগীদের যথাক্রমে ৪২ লাখ ও ৯৫ লাখ টাকা জরিমানা। এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের জন্য আবুল খায়েরের দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভকে ৭২ লাখ টাকা জরিমানা।
২. ২০২২ সালের ৬ জুলাই
ফরচুন সুজ ও এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের বাবা আবুল কালাম মাতবর এবং বোন কনিকা আফরোজ ও তাদের সহযোগীদের যথাক্রমে ১ কোটি ৫০ লাখ ও ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা।
৩. ২০২২ সালের ২ আগস্ট
ওয়ান ব্যাংক ও বিডিকম অনলাইনের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়েরের বাবা আবুল কালাম মাতবর এবং তার প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ ও তাদের সহযোগীদের যথাক্রমে ৩ কোটি ও ৫৫ লাখ টাকা জরিমানা।
৪. ২০২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর
প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়ের ও তার সহযোগীদের ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা জরিমানা, যার মধ্যে সাকিব আল হাসানকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
৫. ২০২৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি
ফরচুন সুজের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়ের ও তার সহযোগীদের ৭৭ কোটি ২১ লাখ টাকা জরিমানা, যার মধ্যে আবুল খায়ের হিরুকে ১১ কোটি টাকা এবং কাজী সাদিয়া হাসানকে ২৫ কোটি টাকা জরিমানা।
৬. ২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি
ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির জন্য যথাক্রমে ৪৯ কোটি ৮৫ লাখ ও ৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
৭. ২০২৫ সালের ৯ এপ্রিল
সোনালী পেপারের শেয়ার কারসাজির জন্য দু’দফায় ৫২ কোটি ও ২৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা জরিমানা, যার মধ্যে সাকিব আল হাসানকে ২৫ লাখ টাকা এবং ২ কোটি ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
৮. ২০২৫ সালের ৭ মে
ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কারসাজির জন্য আবুল খায়ের ও তার সহযোগীদের ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা জরিমানা, যার মধ্যে সাকিব আল হাসানকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এ বিষয়ে বিএসইসির মুখপাত্র ও পরিচালক আবুল কালাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিনিয়োগকারী আবুল খায়েরকে একাধিকবার জরিমানা করা হয়েছে। তিনি বলেন, যে কোনো কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে আগামীতে কমিশন আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।