জাতিসংঘ আণবিক শক্তি সংস্থা ২০০৩ সালে প্রকাশ করে যে, তেহরান গোপনে ১৮ বছর ধরে একটি পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে একাধিক বৃহৎ ও অত্যাধুনিক পারমাণবিক স্থাপনা। তখন থেকেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কূটনৈতিক অঙ্গনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়।
এই বিস্ময়কর তথ্য ফাঁস হওয়ার পর বিশ্ব কূটনীতির চাকা দ্রুত ঘুরতে শুরু করে। পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ সংক্রান্ত চুক্তির (এনপিটি) একজন স্বাক্ষরকারী হিসেবে ইরানের দায়িত্ব লঙ্ঘনের ইঙ্গিত দেয় এটি।
পশ্চিমা শক্তিগুলোর পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনের মতো তেহরানের পুরোনো মিত্ররাও নিন্দা, নিষেধাজ্ঞা ও চাপ প্রয়োগের নানা পদক্ষেপে যুক্ত হয়।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির সরকার দাবি করেছিল যে, এই পারমাণবিক কার্যক্রম শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই আবিষ্কারকে তাদের দীর্ঘদিনের সন্দেহের প্রমাণ হিসেবে দেখেছিল—তাদের বিশ্বাস ছিল, তেহরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করছে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি জর্জ ডব্লিউ. বুশ, বারাক ওবামা, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেন— এই চার মার্কিন প্রেসিডেন্টের শাসনামলে এক কেন্দ্রীয় ইস্যু হিসেবে আলোচনায় ছিল।
এই নেতারা ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করলেও তাদের লক্ষ্য ছিল এক—ইরান যেন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে। কারণ এমন একটি সম্ভাবনা মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্যকে আমূল বদলে দিতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এতে ওই অঞ্চলে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে।
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ ২০০২ সালে ‘অ্যাক্সিস অব ইভিল’ ভাষণে ইরানকে অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর তেহরানের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে জোরালো চাপ প্রয়োগ করেন।
অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার শাসনামলের দুই বছর ব্যয় করেন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানির সরকারগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে তেহরানের সঙ্গে আলোচনায়। এর ফলস্বরূপ ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা।
এই চুক্তির আওতায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও সীমা আরোপের বিনিময়ে তেহরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করা হয়।
প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ওই চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে একতরফা নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় তেহরান চুক্তির শর্তগুলো উপেক্ষা করতে শুরু করে এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের হার বাড়িয়ে ৬০ শতাংশে নিয়ে যায়—যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ৪.৫ শতাংশের তুলনায় অনেক বেশি এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশের অনেক কাছাকাছি।
ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জেসিপিওএ চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। এরপর দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে আসা ট্রাম্প আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অংশ নেয় এবং ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বোমাবর্ষণ করে, যার লক্ষ্য ছিল সেগুলোকে অকার্যকর করে দেওয়া।
এই লেখার সময় পর্যন্ত এটা পরিষ্কার নয় যে, সেই লক্ষ্য কতটা সফল হয়েছে, কারণ হামলার ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির কোনো নিরপেক্ষ মূল্যায়ন এখনো পাওয়া যায়নি।
এখন বিরোধ চললেও আসলে এই জটিলতার সূচনা হয়েছিল ওয়াশিংটন থেকেই, কারণ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরেই। সবকিছুর শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজেনহাওয়ারের একটি ভাষণ দিয়ে।
শান্তির জন্য পরমাণু
১৯৫৩ সালের ৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, পারমাণবিক প্রযুক্তি যখন সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তখন তা মানবজাতির জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে ওঠে।
এই প্রযুক্তি তখন আর কেবল যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া সম্পদ ছিল না—অন্যান্য দেশও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা অর্জন করছিল, যা বিস্তারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছিল।
আইজেনহাওয়ার বলেন, এই অস্ত্র কেবল সৈনিকদের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া যথেষ্ট নয়। আমাদের উচিত এটি তাদের হাতে তুলে দেওয়া, যারা এর সামরিক আবরণ সরিয়ে শান্তির কাজে ব্যবহার করতে জানে।
তিনি জাতিসংঘের অধীনে একটি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন, যার কাজ হবে পারমাণবিক পদার্থকে মানবকল্যাণে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা। এই শক্তিকে চিকিৎসা, কৃষি এবং অন্যান্য শান্তিপূর্ণ প্রয়োজনে ব্যবহার করার পথ খুঁজে বের করার আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, বিশ্বের যে অঞ্চলগুলো জ্বালানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছে, সেখানে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করাই হবে আমাদের একটি বিশেষ লক্ষ্য।
ভাবনাটি ছিল এমন—যেসব শক্তিধর রাষ্ট্র পারমাণবিক পদার্থ উৎপাদনে সক্ষম, তারা তা জাতিসংঘের একটি সংস্থার হাতে তুলে দেবে। সংস্থাটি সেগুলো নিরাপদে সংরক্ষণ করবে এবং গবেষকদের হাতে তুলে দেবে, যাতে তারা এই শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করতে পারেন।
আইজেনহাওয়ারের সেই ভাষণই আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) গঠনের বীজ বপন করে। পাশাপাশি এটি জন্ম দেয় অ্যাটমস ফর পিস বা শান্তির জন্য পরমাণু নামক একটি উদ্যোগের, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সহায়তা করতে শিক্ষা ও প্রযুক্তি সরবরাহ করতে শুরু করে।
পারমাণবিক দৈত্যকে বোতল থেকে বের করে আনা
জাতিসংঘে দেওয়া সেই ভাষণের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অ্যাটমস এনার্জি অ্যাক্ট সংশোধন করে। এর ফলে অন্যান্য দেশকে পারমাণবিক প্রযুক্তি ও উপকরণ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়। শর্ত ছিল, এসব উপকরণ কোনোভাবেই অস্ত্র তৈরির কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে আইজেনহাওয়ার প্রশাসন আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনকে মুক্ত বিশ্বের দেশগুলোর কাছে সীমিত পরিমাণ বিভাজনযোগ্য পদার্থ রপ্তানির অনুমতি দেয় এবং পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণে সহায়তা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
পেন্টাগনের সাবেক প্রতিরোধনীতি পরিচালক পিটার আর. লাভয় আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন -এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লেখেন, এই রপ্তানির উদ্দেশ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব বজায় রাখা, সোভিয়েত প্রভাব হ্রাস করা এবং বিদেশি ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের উৎসে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।
এই কর্মসূচির প্রথম উপকারভোগী ছিল ভারত। এরপর একে একে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইসরায়েল, তুরস্ক, পাকিস্তান, পর্তুগাল, গ্রিস, স্পেন, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং ইরান—এই দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক সহায়তা পেতে শুরু করে।
তেহরানের জন্য একটি চুল্লি
১৯৫৭ সালের ৫ মার্চ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে একটি পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তখন ইরান শাসন করছিলেন শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। অ্যাটমস ফর পিস উদ্যোগের আওতায় এই চুক্তি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভিত্তি স্থাপন করে।
ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে, ঠান্ডা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইরান ছিল একটি কৌশলগত সম্পদ। উইলসন সেন্টার-এ ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে জোনা গ্লিক-আন্টারম্যান লেখেন, তৎকালীন সংরক্ষিত নথিপত্র অনুযায়ী, নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা ইরানকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কৌশলের মূলভিত্তি হিসেবে দেখা হতো এবং অ্যাটমস ফর পিস কর্মসূচি ইরানকে পশ্চিমা জোটের প্রতি অনুগত রাখার একটি উপায় ছিল।
১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র তেহরানকে একটি পাঁচ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক গবেষণা চুল্লি সরবরাহ করে, যার সঙ্গে দেওয়া হয় উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম, যা চুল্লিটি চালাতে প্রয়োজন ছিল।
তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯৭০ সালে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) অনুমোদন করে। এই চুক্তির মাধ্যমে ইরান প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন বা উন্নয়নের চেষ্টা করবে না।
তবে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির মন থেকে সেই লক্ষ্য পুরোপুরি মুছে যায়নি। তিনি তখন বলেছিলেন, যদি ইরান যথেষ্ট শক্তিশালী হয় এবং আমাদের আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষা করতে পারে, তাহলে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। ২০১৩ সালে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির জনক হিসেবে পরিচিত আকবর এতেমাদ বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি (রেজা পাহলভি) আমাকে বলেছিলেন, যদি পরিস্থিতি বদলায়, তাহলে আমাদের পারমাণবিক পথে হাঁটতেই হবে। তার মনে সেই চিন্তা ছিল।
১৯৭৪ সালে গঠিত ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন এতেমাদ এবং তিনিই দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির প্রাথমিক বিকাশের নেতৃত্ব দেন।
সে বছরই শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ঘোষণা দেন, আগামী দুই দশকে ইরানে ২৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে, যার প্রত্যেকটির উৎপাদনক্ষমতা হবে প্রায় ২৩ হাজার মেগাওয়াট। তিনি পুরো পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন চক্র গড়ে তোলার পরিকল্পনাও করেন।
কিন্তু একটি বড় বাধা ছিল, ইরানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ পারমাণবিক প্রকৌশলী ও পদার্থবিজ্ঞানী ছিল না। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের এক প্রবন্ধে আরিয়ানা রোবারি লেখেন, ইরানে পারমাণবিক প্রকৌশল ও পদার্থবিজ্ঞানে প্রশিক্ষিত লোকের অভাব ছিল, তাই তেহরানের গবেষণা চুল্লিটি প্রায় এক দশক ধরে অচল অবস্থায় পড়ে ছিল, কারণ এটি চালানোর মতো দক্ষ জনবল ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় বাধা অতিক্রমের চেষ্টা
১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে ইরানের কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-কে একটি প্রস্তাব দেয়—ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা কর্তৃক নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করার, যাতে করে ইরানের প্রথম প্রজন্মের পারমাণবিক প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়।
এই শিক্ষামূলক কর্মসূচিতে প্রথম দুই বছরের জন্য ইরান প্রায় ১৩ লাখ মার্কিন ডলার (আজকের মূল্যে প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন ডলার) প্রদান করে। তবে এই উদ্যোগ এমআইটির শিক্ষার্থী ও অধ্যাপকদের মধ্যে তীব্র প্রতিবাদের জন্ম দেয়। তারা মোহাম্মদ রেজা পাহলভির মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে এবং আশঙ্কা প্রকাশ করে যে এই কর্মসূচি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে এই চুক্তি ও ওয়াশিংটন-তেহরানের পারমাণবিক সহযোগিতা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এর প্রভাব থেকে যায় দীর্ঘকাল।
প্রযুক্তি ইতিহাসবিদ স্টুয়ার্ট ডব্লিউ. লেসলি ও রবার্ট কারগন এক প্রবন্ধে লেখেন, এমআইটিতে কেউ কল্পনাও করেনি যে তারা শাহের জন্য যে প্রোগ্রাম তৈরি করছিলেন, তা এত দ্রুত ইসলামি বিপ্লবীদের হাতে চলে যাবে। কেউ বিশ্বাস করত না যে তারা যেসব ইরানি শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন, তাদের অনেকেই বিপ্লবের পক্ষে অবস্থান নেবেন।
আরিয়ামেহর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (এএমইউটি), যা এমআইটি-এর আদলে গঠিত হয়েছিল, পরবর্তীতে হয়ে ওঠে বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রস্থল।
বিপ্লবের পরবর্তী মোড়
প্রথমদিকে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বাধীন নতুন ইসলামি সরকার শাহের পারমাণবিক প্রকল্পগুলোকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। এই খাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বহু অধ্যাপক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
ফ্লোরিডা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হোমায়ুনভাশ ব্যাখ্যা করেন, ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর ইরানিরা পারমাণবিক শক্তির প্রতি অত্যন্ত বিরূপ ছিল। তারা মনে করত, এই প্রকল্প শাহের ‘সাদা হাতি’—অর্থাৎ এক অকার্যকর ও ব্যয়বহুল উদ্যোগ।
তিনি বিবিসিকে বলেন, তারা প্রকল্পটি স্থগিত করে দেয় এবং প্রায় পুরোপুরি ভেঙে ফেলে। প্রায় ৫/৬ বছর ধরে পারমাণবিক শক্তিকে তারা সম্পূর্ণ অবহেলা করে। তাদের ধারণা ছিল, এটি কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যই উপযোগী, অথচ ইরানের তেলসম্পদ ছিল প্রচুর।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামি বিপ্লবের নেতৃত্ব বুঝতে শুরু করে পারমাণবিক প্রযুক্তির কৌশলগত গুরুত্ব। তারা শুধু দেশত্যাগী বিশেষজ্ঞদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে না বরং নিজস্ব গোপন পারমাণবিক কর্মসূচিও শুরু করে।
অপ্রত্যাশিত পরিণতি: শান্তির বীজ থেকে অস্ত্রের ছায়া
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়-অ্যাটমস ফর পিস প্রকল্প আসলে কতটা প্রভাব ফেলেছিল অন্যান্য দেশের পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নে, বিশেষ করে ইরানের বর্তমান কর্মসূচিতে?
অধ্যাপক মোহাম্মদ হোমায়ুনভাশ বলেন, এই উদ্যোগের পেছনে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের মূল উদ্বেগ ছিল—পারমাণবিক প্রযুক্তি যদি অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে। যাতে আরও দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের পথে না হাঁটে, সেই উদ্দেশ্যে তখন ধারণা করা হয়েছিল, যদি তাদের শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট মাত্রার পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তা উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক হোমায়ুনভাশ।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউরেনিয়াম বিক্রি করত না বরং গবেষণাগার পর্যায়ের সীমিত পরিমাণে তা ভাড়ায় দিত, যা চুল্লির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশে পারমাণবিক শক্তি নিয়ে গবেষণা ও অধ্যয়নের পথ সুগম করে দেয়।
তবে পেছনে ফিরে তাকালে, অ্যাটমস ফর পিস প্রকল্প পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারে কতটা ভূমিকা রেখেছে—তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত নন।
অধ্যাপক হোমায়ুনভাশ মনে করেন, এটা বলা যেতে পারে যে অ্যাটমস ফর পিস এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছিল, যেখানে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তি হস্তান্তর সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু একবার দেশগুলো এই প্রযুক্তি ব্যবহার শিখে ফেললে, তারা নিজেদের মতো করে বিভিন্ন পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
সীমারেখা কতটা স্পষ্ট?
তবে অধ্যাপক হোমায়ুনভাশ মনে করেন, এটিকে সরলভাবে বলা কঠিন যে অ্যাটমস ফর পিস না থাকলে কিছু দেশ আজকের পারমাণবিক অবস্থানে পৌঁছাতে পারত না। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর যুক্তির শৃঙ্খলটা অনেক জটিল—এটা সরাসরি একটি রেখা টেনে বলা যায় না, তাই আমি সেটা করব না।
অন্যদিকে, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আইজেনহাওয়ারের এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক বিস্তারকে উৎসাহিত করেছে।
জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক জন ক্রিগে বলেন, এখন অনেক নতুন গবেষণা দেখাচ্ছে, এই উদ্যোগ কতটা বিপজ্জনক ছিল এবং কীভাবে অ্যাটমস ফর পিস প্রকল্প আসলে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির বিকাশকে উৎসাহ ও সহায়তা করেছে।
তিনি আরও বলেন, তখন ভাবা হয়েছিল যে শান্তিপূর্ণ ও সামরিক পারমাণবিক প্রযুক্তির মধ্যে একটি স্পষ্ট রেখা টানা সম্ভব। কিন্তু সেটি ছিল একেবারেই সরলীকৃত ধারণা—এবং ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তা ভুল।’
শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তি ভাগ করে নেওয়ার বিষয়টি পারমাণবিক অস্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে গভীর প্রভাব ফেলে—এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এই মতের সমর্থকরা প্রায়ই ভারত ও পাকিস্তানের উদাহরণ দেন—যেসব দেশের প্রথম পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা অ্যাটমস ফর পিস উদ্যোগের অধীনে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন এবং পরে পারমাণবিক বোমা তৈরি করেন। তবে এই মূল্যায়নে শুধু সফল বিস্তার নয়, প্রতিরোধের ঘটনাগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
পিটার আর. লাভয় লিখেছেন, অনেক বেশি ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বৈজ্ঞানিক বা শিল্প পর্যায়ের পারমাণবিক উপকরণ সামরিক ব্যবহারের জন্য সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ধরা পড়েছে এবং ব্যর্থ হয়েছে—আর তা সম্ভব হয়েছে অ্যাটমস ফর পিস-এর আওতায় গঠিত নিরাপত্তা কাঠামোর কারণে। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া এর উদাহরণ।
তবে ইরানের ক্ষেত্রে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বোমাবর্ষণের পর এখনো স্পষ্ট নয়, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির কতটা অবশিষ্ট আছে এবং ভবিষ্যৎ কী হতে পারে।