ঢাকা , শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রযুক্তির উৎকর্ষে ঘরে বসেই মিলছে ভূমি খাতের সব সেবা

  • ডেস্ক :
  • আপডেট সময় ১২:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ মে ২০২৪
  • 40

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিগত দিক থেকে কোন জাতি কতটা উন্নত সে অনুপাত ধরেই যেকোন রাষ্ট্রীয় সেবায় কে কতটা স্মার্ট সেটি নির্ণয় করা হয়। প্রযুক্তি অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সকল নাগরিক সেবা এখন প্রায় শতভাগই প্রযুক্তি নির্ভর। সময়ের ব্যবধানে অন্যান্য সকল সেবা খাতের মত ভূমি সেবা খাতেও লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। এখন ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) এবং নামজারিসহ ভূমি সেবা খাতের সকল সেবাই পাওয়া যায় অনলাইনের মাধ্যমে। হয়রানি, ভোগান্তি, দুর্নীতি ইত্যাদি নেতিবাচক কর্মকাণ্ড রোধে ভূমি মন্ত্রণালয়ের এমন ডিজিটালাইজেশন উদ্যোগ প্রসংশা কুড়িয়ে নিচ্ছে ভূমি সেবাপ্রার্থীদের নিকট থেকে। ঘরে বসেই অনলাইনে জমির নিবন্ধন, নামজারি, খাজনাসহ সব ধরনের কাজ সারতে পারায় সাশ্রয় হচ্ছে সময়, শ্রম এবং খরচ সবই। এতে অতিরিক্ত দালিলিক প্রমাণাদি সংরক্ষণের ঝামেলা কমার সঙ্গে সঙ্গে ভূমি সেবা খাতে এসেছে স্বচ্ছতা ও দ্রুত সময়ে সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা। ভূমি সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভূমি অফিস গুলোতে আগে ১শ টাকার সেবা নেয়ার জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করার পরও ভোগান্তি শেষ হত না। দুর্নীতির কারণে অনেক তথ্যই থেকে যেত সেবাপ্রার্থীদের অজানা। কিন্তু ভূমি খাতে ডিজিটালাইজেশনের কারণে এখন কোন সেবায় কত খরচ, কোন ফি কিভাবে কোথায় জমা দিতে হয়, কখন কিভাবে কোন সেবা নেয়া যায় সবই সেবাপ্রার্থীদের সামনে স্পষ্ট।

ফেনীর ছাগলনাইয়া সাব-রেজিষ্টি অফিসের দলিল লেখক আবদুল মোতালেব জানান, জমির নিবন্ধন, নামজারি, খাজনাসহ সব ধরনের কাজে প্রযুক্তির ছোঁয়া এলেও এখনও নামজারি বা খাজনা দেয়ার জন্য পৌরসভা/ইউনিয়ন ভূমি অফিসের মুখোপেক্ষী হতে হয়। যার কারণে এখনও অবৈধ অর্থের লেনদেন বা জনগণের সময়ের অপচয় হচ্ছে। খাজনা সমন্বয় এবং খারিজের প্রতিবেদনের জন্য আমরা এখনও ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ও উপজেলা ভূমি সহকারী কমিশনারের সামনে হাজির হতে হয়। যার কারণে সরকার বা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে আমরা আমরা ব্যাক্তির কাছে জিম্মি থাকতে হয়। তিনি বলেন, আমরা যেভাবে ঘরে বসেই নিজের ইচ্ছেমত যখন তখন এখন ইউটিলিটি বিল প্রদান করতে পারি আমরা যদি ভূমি খাতের বিভিন্ন সেবাও ঠিক সেভাবেই নিতে পারি তখন জনগণ আর কোন ব্যাক্তির কাছে জিম্মি থাকতে হবে না। ভূমি কর্মকর্তারা এখন ইচ্ছে করলেই, নাল অথবা অকৃষি জমিকে আবাসিক ভূমি হিসেবে উপস্থাপন করেই এর খাজনা বাড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এখন যদি জমির মালিক তার সকল আইনি কাগজপত্র অনলাইনের মাধ্যমে দাখিল করে তার দাখিলকৃত দলিলাদির ভিত্তিতে সেবা নিতে পারেন ঠিক সেভাবেই ডিজিটালাইজেশন করা যায় তাহলে ভূমি সেবা গ্রহীতাদের জন্য সেটিই হবে প্রযুক্তির কাঙ্খিত সেবা। সুতরাং বর্তমানে ভূমি সেবার বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন অনলাইনের আওতায় এসেছে উক্ত কার্যক্রমগুলো জনগণের জন্য আরো ভালোভাবে উন্মুক্ত হলে তখন জনগণ তাদের ইচ্ছেমত ভূমি উন্নয়ন কর প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম করতে সম্পন্ন করতে পারবে। ফেনীর ছাগলনাইয়ার মহামায়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে নামজারির কাজে এসেছিলেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভূমি সেবাখাতে ডিজিটালাইজেশনের কারণে এখন অনেকটা সহজ ও স্বচ্ছ হয়েছে। তবে এখনও নামজারির জন্য অনলাইনে আবেদনের পর উপজেলা ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসে আসতে হয়। মুখোপেক্ষী থাকতে হয় উভয় অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারিদের দিকে। উক্ত খাত পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশন হয়ে গেলে তখন হয়ত অফিসে না এসে শুধু অনলাইনে সকল দলিলপত্র সাবমিট করলেই নামজারির খতিয়ান পাওয়া যাবে। দেশের অন্যান্য সেবাখাতের মত ভূমি সেবা খাতের সকল সেবা যদি ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে স্বচ্ছ ও সহজলভ্য হয়ে যায় তখন জনগণ যেমন তার কাঙ্খিত সেবাটি সময়মত পাবে একইসঙ্গে উক্ত খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে এটি জোরালো ভূমিকা পালন করবে। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে খাজনা দিতে আসা ফরহাদ হোসেন জানান, একসময় আমরা প্রতিবছরের খাজনার দাখিলাগুলো খুব যত্নে সংরক্ষণ করে রাখতাম। কারণ বিগত বছরের দাখিলাগুলো যদি পরের বছর ভূমি অফিসে দেখাতে না পারতাম তাহলে অফিসের লোকজন খাজনা যত টাকা চায় ঠিক তত টাকা পরিশোধ করতে হত। ভূমি অফিসের লোকজন তাদের অফিসের কোন খাজনার প্রমাণাদি তল্লাশি করতো না। কারণ এতে সেবা গ্রহিতার নিকট থেকে অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করা যেত। কিন্তু ভূমি সেবাখাতে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগার পর অনলাইনেই সবকিছু সংরক্ষণ থাকে, যার কারণে অফিসের লোকজনের এখন সেবাগ্রহীতার নিকট থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের সুযোগ নেই। ভূমির মালিকরাও নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। ডিজিটালাইজেশনের কারণে ভূমি মালিকদের সেবায় যেমন সচ্ছতা এসেছে তেমনই অফিসের লোকজনের দুর্নীতির সুযোগও কমে এসেছে। তবে ভূমিখাতে ডিজিটালাইজেশন সবেমাত্র শুরু হয়েছে, ভূমিসেবা খাতের সকল সেক্টর প্রযুক্তির আয়ত্ত্বে এসে গেলে দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ এ খাতে পুরোপুরি সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ফেনীর ছাগলনাইয়ার মহামায়া ইউনিনের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো: আবদুল হক জানান, সরকারি ভাবে অনলাইনে ভূমি কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর আমরা অনলাইনে ভূমি সংক্রান্ত সকল সেবা গ্রহণের জন্য সেবা গ্রহীতাদের উৎসাহ প্রদান করার পাশাপাশি কিভাবে কোন সেবা পাওয়া যায় সে ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতে বেশিরভাগ সময় লোকবল সংকট থাকে। যার কারণে আমরা জনগণকে সঠিকভাবে সেবা প্রদান করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন আমাদের অফিসে কোন নগদ টাকার লেনদেন নেই। আমরা সেবাপ্রার্থীর কাঙ্খিত সেবা দেয়ার পর তারা নিজেরাই সুবিধা ও নিজের সময় অনুযায়ী মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভূমি উন্নয়ন করসহ সবকিছু প্রদান করতে পারে যেকোন সময় ঘরে বসেই।

বিশেষ করে ভূমির ই-নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম অনলাইনের আওতায় আসার কারণে গ্রাহকের মধ্যে সেবার ব্যাপারে স্বচ্ছতা ও সন্তুষ্টি কাজ করছে। কারণ এখন সেবাপ্রার্থী জনগণ নিজেই তাদের সেবা কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত থাকে। সেবার অবস্থা ও সমস্যাগুলো সম্পর্কেও তারা অবগত থাকে। আগে যখন সনাতন পদ্ধতিতে সেবা প্রদান করা হতো তখন দেখায় যেত সেবা প্রদানে বিলম্ব হলে অনেক সময় সেবাপ্রার্থীরা অফিসের লোকজনকে দোষারোপ করতো। এখন প্রত্যেকটি সেবা সম্পর্কে জনগণের জানার ও বুঝার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেবা কার্যক্রমের দায় দায়িত্বের একটি অংশ জনগণের হাতেই আছে। তাই এখন আমাদের সেবা প্রদান ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রেও প্রক্রিয়াগুলো অনেক সহজ হয়েছে।

ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ফখরুল ইসলাম জানান, তথ্য প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতিটি খাতে প্রযুক্তির সাহায্যে সেবা প্রদান করায় সেবাপ্রার্থী জনগণের জন্য সেবা গ্রহণ পূর্বের চেয়ে স্বচ্ছ ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্ভব হয়েছে। ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে এখন যেকোন ভূমিসেবা গ্রহণ করতে পারছে। অনলাইনে আবেদনের পর ই-পর্চার কপি ডাকযোগে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থাও আছে, যার মাধ্যমে সেবাগ্রহীতারা সহজে ই-পর্চার কপি পেয়ে যায়। যেকোন কেউ যদি অন্য কারো মাধ্যমে ভূমি অফিসের সেবা নিতে চায় তাহলে তিনি প্রতরণা বা অতিরিক্ত অর্থিক লেনদেনের সম্ভাবনা থেকেই যায়। তবে সারাদেশের উপজেলা ভূমি অফিসগুলো সরাসরি জনগণের কাছেই সেবা পৌঁছে দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে। তিনি বলেন, এখন হোল্ডিং খোলার পর একবারই কেবল তহশিলদার বা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কনফার্মেশন বা সত্যতা নিশ্চিত করে নেয়ার প্রয়োজন হয়। এরপর থেকে সে খতিয়ানে সারাজীবন ঘরে বসেই ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান করার প্রক্রিয়া অনলাইনে চালু আছে। তবে ইউনিয়ন ভূমি অফিস কিংবা অন্য কোন দালাল যদি সেবার নামে সেবাগ্রহীতাদের বিভ্রান্ত করে সে ব্যাপারে আমরা তৎপর আছি। অভিযোগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এসব অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে উপজেলা ভূমি সহকারী কমিশনারের সরকারি মোবাইল নম্বরে জনগণের নিকট থেকে অভিযোগ শুনার ব্যবস্থা রয়েছে।

তবে এখনও জটিল কিছু বিষয় অনলাইনের আওতার আসার জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে, সেগুলোও অতি শীগ্রই অনলাইনের আওতায় এসে যাবে। কিছু দিনের মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের একটি তালিকা করে নির্দিষ্ট একটি আবেদন ফি নির্ধারিত করে দেয়া হবে। যাতে অনলাইনে যে কেউ তাদের মাধ্যমে সহজেই অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ পায়। এতে প্রতারণা ও অতিরিক্ত অর্থ খোয়ানো থেকে সেবা গ্রহীতারা নিষ্কৃতি পাবে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাইজেশন, নলেজ ম্যানেজমেন্ট ও পারফরমেন্স (ডিকেএমপি) অনু বিভাগের উপ সচিব মুহাম্মাদ আব্দুল লতিফ জানান, বর্তমানে ই-নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর থেকে শুরু করে ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন যেসব সেবা আছে আমরা সেগুলো সেগুলো আমরা পুরোপুরো প্রযুক্তি সহায়তায় প্রদান করার চেষ্টা করছি। ভূমি সেবা খাতের প্রতিটি সেক্টরই মোটামোটি প্রযুক্তির আওতায় এসে গেছে। এরপরও প্রথম দিকে কিছু সমস্যা হয়ত থাকতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমরা কোন ত্রুটির ব্যাপারে অবগত হওয়ার পর সেগুলো সমাধান করার চেষ্টা করি। দেশের ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায় বর্তমানে প্রযুক্তির সহায়তায় অনলাইনের মাধ্যমে আমরা ভূমি খাতের সকল সেবা প্রদান করে আসছি। দেশের ভূমি কার্যক্রম প্রায় শতভাগই এখন অনলাইনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও ভূমির মালিকদের জমিসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য নিয়ে স্মার্ট কার্ড দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভূমি ব্যবহার ও মালিকানা স্বত্ব আইনের আওতায় নাগরিকদের ‘সার্টিফিকেট অব ল্যান্ড ওনারশিপ’ বা সিএলও দেয়া হবে, যেখানে ভূমি মালিকানার সব তথ্য থাকবে। ফলে জমির মালিকানা প্রমাণের জন্য দলিলাদির প্রয়োজন পড়বে না। তাছাড়া ভূমি মালিকদের ২৪ ঘণ্টা ভূমি সেবা প্রদান করার জন্য হটলাইন ১৬১২২ তো চালু আছেই।

ট্যাগস

প্রযুক্তির উৎকর্ষে ঘরে বসেই মিলছে ভূমি খাতের সব সেবা

আপডেট সময় ১২:৫২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ মে ২০২৪

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিগত দিক থেকে কোন জাতি কতটা উন্নত সে অনুপাত ধরেই যেকোন রাষ্ট্রীয় সেবায় কে কতটা স্মার্ট সেটি নির্ণয় করা হয়। প্রযুক্তি অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সকল নাগরিক সেবা এখন প্রায় শতভাগই প্রযুক্তি নির্ভর। সময়ের ব্যবধানে অন্যান্য সকল সেবা খাতের মত ভূমি সেবা খাতেও লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। এখন ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) এবং নামজারিসহ ভূমি সেবা খাতের সকল সেবাই পাওয়া যায় অনলাইনের মাধ্যমে। হয়রানি, ভোগান্তি, দুর্নীতি ইত্যাদি নেতিবাচক কর্মকাণ্ড রোধে ভূমি মন্ত্রণালয়ের এমন ডিজিটালাইজেশন উদ্যোগ প্রসংশা কুড়িয়ে নিচ্ছে ভূমি সেবাপ্রার্থীদের নিকট থেকে। ঘরে বসেই অনলাইনে জমির নিবন্ধন, নামজারি, খাজনাসহ সব ধরনের কাজ সারতে পারায় সাশ্রয় হচ্ছে সময়, শ্রম এবং খরচ সবই। এতে অতিরিক্ত দালিলিক প্রমাণাদি সংরক্ষণের ঝামেলা কমার সঙ্গে সঙ্গে ভূমি সেবা খাতে এসেছে স্বচ্ছতা ও দ্রুত সময়ে সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা। ভূমি সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভূমি অফিস গুলোতে আগে ১শ টাকার সেবা নেয়ার জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করার পরও ভোগান্তি শেষ হত না। দুর্নীতির কারণে অনেক তথ্যই থেকে যেত সেবাপ্রার্থীদের অজানা। কিন্তু ভূমি খাতে ডিজিটালাইজেশনের কারণে এখন কোন সেবায় কত খরচ, কোন ফি কিভাবে কোথায় জমা দিতে হয়, কখন কিভাবে কোন সেবা নেয়া যায় সবই সেবাপ্রার্থীদের সামনে স্পষ্ট।

ফেনীর ছাগলনাইয়া সাব-রেজিষ্টি অফিসের দলিল লেখক আবদুল মোতালেব জানান, জমির নিবন্ধন, নামজারি, খাজনাসহ সব ধরনের কাজে প্রযুক্তির ছোঁয়া এলেও এখনও নামজারি বা খাজনা দেয়ার জন্য পৌরসভা/ইউনিয়ন ভূমি অফিসের মুখোপেক্ষী হতে হয়। যার কারণে এখনও অবৈধ অর্থের লেনদেন বা জনগণের সময়ের অপচয় হচ্ছে। খাজনা সমন্বয় এবং খারিজের প্রতিবেদনের জন্য আমরা এখনও ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ও উপজেলা ভূমি সহকারী কমিশনারের সামনে হাজির হতে হয়। যার কারণে সরকার বা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে আমরা আমরা ব্যাক্তির কাছে জিম্মি থাকতে হয়। তিনি বলেন, আমরা যেভাবে ঘরে বসেই নিজের ইচ্ছেমত যখন তখন এখন ইউটিলিটি বিল প্রদান করতে পারি আমরা যদি ভূমি খাতের বিভিন্ন সেবাও ঠিক সেভাবেই নিতে পারি তখন জনগণ আর কোন ব্যাক্তির কাছে জিম্মি থাকতে হবে না। ভূমি কর্মকর্তারা এখন ইচ্ছে করলেই, নাল অথবা অকৃষি জমিকে আবাসিক ভূমি হিসেবে উপস্থাপন করেই এর খাজনা বাড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এখন যদি জমির মালিক তার সকল আইনি কাগজপত্র অনলাইনের মাধ্যমে দাখিল করে তার দাখিলকৃত দলিলাদির ভিত্তিতে সেবা নিতে পারেন ঠিক সেভাবেই ডিজিটালাইজেশন করা যায় তাহলে ভূমি সেবা গ্রহীতাদের জন্য সেটিই হবে প্রযুক্তির কাঙ্খিত সেবা। সুতরাং বর্তমানে ভূমি সেবার বিভিন্ন কার্যক্রম যেমন অনলাইনের আওতায় এসেছে উক্ত কার্যক্রমগুলো জনগণের জন্য আরো ভালোভাবে উন্মুক্ত হলে তখন জনগণ তাদের ইচ্ছেমত ভূমি উন্নয়ন কর প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম করতে সম্পন্ন করতে পারবে। ফেনীর ছাগলনাইয়ার মহামায়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে নামজারির কাজে এসেছিলেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভূমি সেবাখাতে ডিজিটালাইজেশনের কারণে এখন অনেকটা সহজ ও স্বচ্ছ হয়েছে। তবে এখনও নামজারির জন্য অনলাইনে আবেদনের পর উপজেলা ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসে আসতে হয়। মুখোপেক্ষী থাকতে হয় উভয় অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারিদের দিকে। উক্ত খাত পুরোপুরি ডিজিটালাইজেশন হয়ে গেলে তখন হয়ত অফিসে না এসে শুধু অনলাইনে সকল দলিলপত্র সাবমিট করলেই নামজারির খতিয়ান পাওয়া যাবে। দেশের অন্যান্য সেবাখাতের মত ভূমি সেবা খাতের সকল সেবা যদি ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে স্বচ্ছ ও সহজলভ্য হয়ে যায় তখন জনগণ যেমন তার কাঙ্খিত সেবাটি সময়মত পাবে একইসঙ্গে উক্ত খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধে এটি জোরালো ভূমিকা পালন করবে। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে খাজনা দিতে আসা ফরহাদ হোসেন জানান, একসময় আমরা প্রতিবছরের খাজনার দাখিলাগুলো খুব যত্নে সংরক্ষণ করে রাখতাম। কারণ বিগত বছরের দাখিলাগুলো যদি পরের বছর ভূমি অফিসে দেখাতে না পারতাম তাহলে অফিসের লোকজন খাজনা যত টাকা চায় ঠিক তত টাকা পরিশোধ করতে হত। ভূমি অফিসের লোকজন তাদের অফিসের কোন খাজনার প্রমাণাদি তল্লাশি করতো না। কারণ এতে সেবা গ্রহিতার নিকট থেকে অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করা যেত। কিন্তু ভূমি সেবাখাতে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগার পর অনলাইনেই সবকিছু সংরক্ষণ থাকে, যার কারণে অফিসের লোকজনের এখন সেবাগ্রহীতার নিকট থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের সুযোগ নেই। ভূমির মালিকরাও নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। ডিজিটালাইজেশনের কারণে ভূমি মালিকদের সেবায় যেমন সচ্ছতা এসেছে তেমনই অফিসের লোকজনের দুর্নীতির সুযোগও কমে এসেছে। তবে ভূমিখাতে ডিজিটালাইজেশন সবেমাত্র শুরু হয়েছে, ভূমিসেবা খাতের সকল সেক্টর প্রযুক্তির আয়ত্ত্বে এসে গেলে দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ এ খাতে পুরোপুরি সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ফেনীর ছাগলনাইয়ার মহামায়া ইউনিনের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো: আবদুল হক জানান, সরকারি ভাবে অনলাইনে ভূমি কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর আমরা অনলাইনে ভূমি সংক্রান্ত সকল সেবা গ্রহণের জন্য সেবা গ্রহীতাদের উৎসাহ প্রদান করার পাশাপাশি কিভাবে কোন সেবা পাওয়া যায় সে ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতে বেশিরভাগ সময় লোকবল সংকট থাকে। যার কারণে আমরা জনগণকে সঠিকভাবে সেবা প্রদান করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন আমাদের অফিসে কোন নগদ টাকার লেনদেন নেই। আমরা সেবাপ্রার্থীর কাঙ্খিত সেবা দেয়ার পর তারা নিজেরাই সুবিধা ও নিজের সময় অনুযায়ী মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভূমি উন্নয়ন করসহ সবকিছু প্রদান করতে পারে যেকোন সময় ঘরে বসেই।

বিশেষ করে ভূমির ই-নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম অনলাইনের আওতায় আসার কারণে গ্রাহকের মধ্যে সেবার ব্যাপারে স্বচ্ছতা ও সন্তুষ্টি কাজ করছে। কারণ এখন সেবাপ্রার্থী জনগণ নিজেই তাদের সেবা কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত থাকে। সেবার অবস্থা ও সমস্যাগুলো সম্পর্কেও তারা অবগত থাকে। আগে যখন সনাতন পদ্ধতিতে সেবা প্রদান করা হতো তখন দেখায় যেত সেবা প্রদানে বিলম্ব হলে অনেক সময় সেবাপ্রার্থীরা অফিসের লোকজনকে দোষারোপ করতো। এখন প্রত্যেকটি সেবা সম্পর্কে জনগণের জানার ও বুঝার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেবা কার্যক্রমের দায় দায়িত্বের একটি অংশ জনগণের হাতেই আছে। তাই এখন আমাদের সেবা প্রদান ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রেও প্রক্রিয়াগুলো অনেক সহজ হয়েছে।

ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ফখরুল ইসলাম জানান, তথ্য প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতিটি খাতে প্রযুক্তির সাহায্যে সেবা প্রদান করায় সেবাপ্রার্থী জনগণের জন্য সেবা গ্রহণ পূর্বের চেয়ে স্বচ্ছ ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্ভব হয়েছে। ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে এখন যেকোন ভূমিসেবা গ্রহণ করতে পারছে। অনলাইনে আবেদনের পর ই-পর্চার কপি ডাকযোগে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থাও আছে, যার মাধ্যমে সেবাগ্রহীতারা সহজে ই-পর্চার কপি পেয়ে যায়। যেকোন কেউ যদি অন্য কারো মাধ্যমে ভূমি অফিসের সেবা নিতে চায় তাহলে তিনি প্রতরণা বা অতিরিক্ত অর্থিক লেনদেনের সম্ভাবনা থেকেই যায়। তবে সারাদেশের উপজেলা ভূমি অফিসগুলো সরাসরি জনগণের কাছেই সেবা পৌঁছে দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে। তিনি বলেন, এখন হোল্ডিং খোলার পর একবারই কেবল তহশিলদার বা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কনফার্মেশন বা সত্যতা নিশ্চিত করে নেয়ার প্রয়োজন হয়। এরপর থেকে সে খতিয়ানে সারাজীবন ঘরে বসেই ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান করার প্রক্রিয়া অনলাইনে চালু আছে। তবে ইউনিয়ন ভূমি অফিস কিংবা অন্য কোন দালাল যদি সেবার নামে সেবাগ্রহীতাদের বিভ্রান্ত করে সে ব্যাপারে আমরা তৎপর আছি। অভিযোগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এসব অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে উপজেলা ভূমি সহকারী কমিশনারের সরকারি মোবাইল নম্বরে জনগণের নিকট থেকে অভিযোগ শুনার ব্যবস্থা রয়েছে।

তবে এখনও জটিল কিছু বিষয় অনলাইনের আওতার আসার জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে, সেগুলোও অতি শীগ্রই অনলাইনের আওতায় এসে যাবে। কিছু দিনের মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের একটি তালিকা করে নির্দিষ্ট একটি আবেদন ফি নির্ধারিত করে দেয়া হবে। যাতে অনলাইনে যে কেউ তাদের মাধ্যমে সহজেই অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ পায়। এতে প্রতারণা ও অতিরিক্ত অর্থ খোয়ানো থেকে সেবা গ্রহীতারা নিষ্কৃতি পাবে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাইজেশন, নলেজ ম্যানেজমেন্ট ও পারফরমেন্স (ডিকেএমপি) অনু বিভাগের উপ সচিব মুহাম্মাদ আব্দুল লতিফ জানান, বর্তমানে ই-নামজারি, ভূমি উন্নয়ন কর থেকে শুরু করে ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন যেসব সেবা আছে আমরা সেগুলো সেগুলো আমরা পুরোপুরো প্রযুক্তি সহায়তায় প্রদান করার চেষ্টা করছি। ভূমি সেবা খাতের প্রতিটি সেক্টরই মোটামোটি প্রযুক্তির আওতায় এসে গেছে। এরপরও প্রথম দিকে কিছু সমস্যা হয়ত থাকতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমরা কোন ত্রুটির ব্যাপারে অবগত হওয়ার পর সেগুলো সমাধান করার চেষ্টা করি। দেশের ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায় বর্তমানে প্রযুক্তির সহায়তায় অনলাইনের মাধ্যমে আমরা ভূমি খাতের সকল সেবা প্রদান করে আসছি। দেশের ভূমি কার্যক্রম প্রায় শতভাগই এখন অনলাইনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও ভূমির মালিকদের জমিসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য নিয়ে স্মার্ট কার্ড দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভূমি ব্যবহার ও মালিকানা স্বত্ব আইনের আওতায় নাগরিকদের ‘সার্টিফিকেট অব ল্যান্ড ওনারশিপ’ বা সিএলও দেয়া হবে, যেখানে ভূমি মালিকানার সব তথ্য থাকবে। ফলে জমির মালিকানা প্রমাণের জন্য দলিলাদির প্রয়োজন পড়বে না। তাছাড়া ভূমি মালিকদের ২৪ ঘণ্টা ভূমি সেবা প্রদান করার জন্য হটলাইন ১৬১২২ তো চালু আছেই।