ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি দখলদারিত্ব এবং সামরিক হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ উত্তাল যুক্তরাষ্ট্রের দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই বিক্ষোভ দমনে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটির প্রশাসন। গ্রেফতার করা হয়েছে আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। শুধু শিক্ষার্থীই নয়, ৫০ জন অধ্যাপককেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
গত ১৭ এপ্রিল নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই বিক্ষোভের সূচনা করেন। বিক্ষোভ থেকে তারা গাজায় যুদ্ধ বন্ধ, ইসরায়েল সরকার ও ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক ছিন্নসহ বেশ কিছু দাবি জানান।
এছাড়াও ইউরোপের অন্তত ১২টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে মার্কিন শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভ। এই সময়ে ইউরোপেও তিন শতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছড়িয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এমন চিন্তাশীল, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নাগরিকদের একটি ছোট্ট গোষ্ঠীও গোটা বিশ্বকে পাল্টে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে নীতিগত এবং সামাজিক পরিবর্তন সাধারণত দুটি ভিন্ন রূপে হয়ে থাকে। কখনও কখনও দুটো পন্থায় কিছুটা মেলবন্ধনও দেখা যায়।
প্রথমটি হচ্ছে টপ-ডাউন প্রক্রিয়া, যে পরিবর্তন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু হয়। এতে শাসকগোষ্ঠী এবং ধনীশ্রেণি তাদের প্রতিষ্ঠান এবং নীতিবিষয়ক কেন্দ্রের মাধ্যমে রাজনৈতিক শ্রেণিকে তাদের পছন্দনীয় নীতি ও দাবি মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। একবার এগুলো আইনে পরিণত হলে তখন আদালত এবং নির্বাহী শাখা এসব প্রয়োগ করতে পারে। তখন করপোরেট মিডিয়া জনমত তৈরির জন্য সেগুলোকে জনগণের কাছে প্রচার করে।
সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সিতে সোমবার প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক সামি আল আরিয়ানের নিবন্ধে এমন সব দাবি উঠে এসেছে।
দ্বিতীয় পন্থাটি হল, বোটম-আপ পদ্ধতি, যাতে পরিবর্তন জনগণের পর্যায় থেকে শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে নীতিগত ও সামাজিক পরিবর্তন শুরু হয় একটি ভিন্ন ধারার গোষ্ঠীর প্রভাবে। যারা স্থিতাবস্থার সমালোচনা করে এবং কঠোর পরিবর্তন চায়, যা শাসক শ্রেণি এবং রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের কর্তারা মেনে নিতে চান না। ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রমিক আন্দোলনও এই শ্রেণিভুক্ত। সাধারণত এই পদ্ধতির আওতায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া দাবিগুলো জোরালো সমর্থন অর্জন করলে তা রাষ্ট্রের শক্তিশালী অংশ শাসকশ্রেণির তীব্র নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের শিকার হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র এ সময় সহিংসভাবে আন্দোলন দমাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এই ধরনের জোরালো ও বিস্তৃত জনমত অবশেষে রাজনৈতিক শ্রেণিসহ আইনি ব্যবস্থার মধ্যে গোটা রাষ্ট্রে নীতিগত পরিবর্তনের সূচনা করে।
শিক্ষার্থীদের সক্রিয়তায় ভীত ইহুদিবাদী অভিজাত গোষ্ঠী
ইহুদিবাদী অভিজাত গোষ্ঠী এবং মার্কিন আধিপত্যবাদের রক্ষক ও পক্ষের শক্তিরা বর্তমানে শিক্ষার্থীদের সক্রিয়তা দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। সাধারণ জনগণকে প্রভাবিত করার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে সমর্থন করার প্রতি জনমত সৃষ্টি এবং ফিলিস্তিনি অধিকারকে সমর্থন করার প্রতি মার্কিন জনমত ও মনোভাব পাল্টে দেওয়ার মতো শক্তি রয়েছে এই আন্দোলনের। ইহুদিবাদী শাসনের সমালোচকদের ইহুদিবিদ্বেষী হিসেবে তকমা দেওয়ায় প্রবণতাকে পাল্টে দিয়েছে এই আন্দোলন।
গত কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শিক্ষার্থীদের সাহসিকতা এবং দৃঢ়তা ছিল অবিশ্বাস্য পর্যায়ের। যদি এমন সব ক্যাম্পাসে এই আন্দোলনের তীব্রতা বজায় থাকে এবং নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর প্রতি জনমত সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তবে মার্কিন রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। বেশিরভাগ কৃতিত্বই ছাত্রদের আন্দোলনকে দেওয়া হবে যা শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জ্বলে উঠেছে।
আমেরিকার সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক শীর্ষ ব্যক্তিত্ব মার্গারেট মিড এই ধরনের পরিবর্তনের বিষয় ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, “কখনও সন্দেহ করবেন না যে, একটি চিন্তাশীল, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নাগরিকদের একটি ছোট্ট গোষ্ঠী গোটা বিশ্বকে পাল্টে দিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, এটিই একমাত্র জিনিস যা এখনও কার্যকর।” সূত্র: আনাদোলু এজেন্সি