শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের বিচরণ বেড়েছে। টানা ১৬ বছর আওয়ামী শাসনামলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল দলটি। এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গত এক মাসে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচি দিয়ে চষে বেড়িয়েছেন জামায়াত নেতারা। এই সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে দলটি।
অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার আাগে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অদৃশ্য সমঝোতা ছিল। কিন্তু নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তী সরকারে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে দৃশ্যমান দুরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের জন্য ‘যৌক্তিক’ সময়ের কথা বললেও জামায়াতের অবস্থান ভিন্ন। জামায়াত তাড়াহুড়ো না করে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে চায়।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই দলের মধ্যে ব্যবধানের এখন আরও কিছু ভিন্ন ইস্যু যোগ হয়েছে। চলছে নেতাদের মধ্যে বাহাস কথাবার্তা। দুই দল থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে তারা এখন আর একই জোটে নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। নেতাকর্মীরা হয় পালিয়েছেন, নয় আত্মগোপনে। আবার কেউ কেউ আটক হয়েছেন। তাই রাজনীতির মাঠে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
আওয়ামী লীগের অবর্তমানে ফাঁকা জায়গায় এখন বড় শক্তি হিসাবে সামনে আসতে চাইছে জামায়াত। সেজন্য মাঠ গুছানোর জন্য সময় প্রয়োজন তাদের। কারণ প্রায় দেড় যুগ ধরে দলটি কোনঠাঁসা ছিল। দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বোঝাপড়া তেমন ছিল না। এখন বোঝাপড়ার জায়গাটা শক্ত করতে চায়। রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম শক্ত করতে চায়। এই কারণে তারা নির্বাচন দেরিতে চায়।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান জানিয়েছেন, বিএনপি নির্বাচনের জন্য তোড়জোড় করছে, যেটাকে এই মুহূর্তে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি না। এই সময় জাতির ক্রাইসিস চলছে। বিভিন্ন জেলা বন্যার কবলে পড়েছে। এটিকে আমরা এই মুহূর্তের রাজনীতি হিসাবে নিয়েছি। আমরা মনে করি, এই বিষয়গুলো সমাধান না করে নির্বাচনের কথা তোলা যৌক্তিক নয়। তাই আমরা নির্বাচন নিয়ে কথা বলছি না।
জামায়াতের আমীরের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে গত ২৮ আগস্ট গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমি আগেই বলেছি, এটা সুপরিকল্পিত একটা চক্রান্ত। কারণ আমরা তো এক-এগারোর কথা ভুলে যাইনি। এক-এগারোতে যেটা হয়েছিল বিরাজনীতিকীকরণের প্রচেষ্টা। যাদের জনসমর্থন নেই, জনগণ মনে করে না যে এরা সরকার চালাতে পারবে, তারা এই ধরনের বিভিন্ন চিন্তাভাবনা করে, আমি কোনো দলের নাম বলছি না। সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে, আমাদের লড়াইটা গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। সেটার জন্যই তো নির্বাচন। এটা তো আমাদের রাইট। আমরা তো নির্বাচনের জন্যই এতদিন লড়াই করেছি, সংগ্রাম করেছি।’
জামায়াতে ইসলামীকে ইঙ্গিত করে বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে বাতিল করা হলো, এর জন্য ওই দলগুলো মিলেই তো আমরা আন্দোলন করেছি। অনেককে নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এমনকি তাদের অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন ওই বিষয়কে বাদ দিয়ে আমি তো অন্য রাজনৈতিক চিন্তা এই মুহূর্তে করব না।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থানের সমালোচনা করে গত ৩০ আগস্ট রাজধানীতে এক সমাবেশে বলেন, কেউ কেউ বলছেন বন্যায় ভাসছি, আবার এখন নির্বাচনের দরকার কী? যারা যেমন, তারা তেমনই কথা বলবেন। কিছু মানুষ আছে, কিছু দল আছে আমাদের সঙ্গে থাকলেও ১৯টা সিট পায়, আমাদের থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে তিনটা সিট পায়, তারা তো ভোটকে ভয় পাবেই। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।
জামায়াতের নির্বাচন দেরিতে চাওয়ার মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যদি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে তাহলে আরও চাপের মুখে পড়বে বিএনপি। নির্বাচন যত দেরিতে হবে বিএনপি তত চাপে পড়বে। আর জামায়াত তত সুবিধাজনক অবস্থানে যাবে। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজনৈতিক দল সংগঠিত হবে।
এদিকে, দলকে শক্তিশালী করতে জামায়াত ইসলামী বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্যের লক্ষ্যেও কাজ শুরু করছে। আলিয়া-কওমীপন্থি আলেমদের মধ্যে বিভাজন দূর করে আলেমদের একতার লক্ষ্যে কাজ করছে দলটি। আর এই উদ্যোগের কারিগর খোদ জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান। ইতোমধ্যে তিনি কওমী-আলিয়ার আলেমদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে ঐক্যের বার্তা দিয়েছেন। জামায়াতের অতীত ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন।
অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামী দলগুলোকে নিজেদের বলয়ে টানার চেষ্টায় রয়েছে জামায়াত। এই দলগুলোর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্ব। এর সুফলও পেয়েছে দলটি। এই দলগুলো জামায়াতের বিষয়ে আগের মতো কট্টর অবস্থানে নেই। তাদের মধ্যে কিছুটা নমনীয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে জামায়াত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। যে কারণে তারা তাদের অভিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়ন না করে এখনই নির্বাচনের ছক নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী নয়। বরং নির্বাচন বিলম্বে অনুষ্ঠিত হলেই সুবিধা বেশি বলে মনে করছে দলটি।