ঢাকা , শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিশেষ সুবিধা দিতেই প্লেসমেন্ট শেয়ার বন্টনে অনিয়ম

  • ডেস্ক :
  • আপডেট সময় ০১:০৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪
  • 14

বিগত সরকারের আমলের কয়েকজন প্রভাবশালী শেয়ারধারীকে বিশেষ সুবিধা দিতে আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নতুন শেয়ার বণ্টন করে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা তুলে নেওয়োর সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল টি কোম্পানির বিরুদ্ধে। এর ফলে কয়েক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান বিপুল মুনাফা তুলে নিলেও বঞ্চিত হয় কোম্পানির অন্যতম মালিক সরকারি তিন প্রতিষ্ঠানক।

জানা যায়, কোম্পানিটি মূলধন বাড়াতে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিদ্যমান শেয়ারধারীদের মধ্যে নতুন ২ কোটি ৩৪ লাখ শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেয়। গত বছরের এপ্রিলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিষয়টি অনুমোদন করে। কোম্পানিাটি প্রতিটি শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১০ টাকা প্রিমিয়ামসহ ১১৯ টাকা ৫৩ পয়সা। একটি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে প্রায় তিনটি নতুন শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত হয় শেয়ারধারীদের মধ্যে। এর মাধ্যমে কোম্পানি ২৮০ কোটি টাকা সংগ্রহের ইচ্ছা ছিল।

এজন্য কোম্পানিটি প্লেসমেন্ট শেয়ারের চাঁদা গ্রহণসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ১৯ জুন থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হলেও ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাহিত ২৮০ কোটি টাকার বিপরীতে মাত্র ৫৪ কোটি টাকার আবেদন জমা পড়ে। এর ফলে চাঁদা গ্রহণের সময় আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়ানোর আবেদন করা হয়। তবে বিএসইসি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।

এর মধ্যেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে কোম্পানিটির পর্যদ থেকে শেখ কবির হোসেন, নাফিজ সরাফাতসহ বিগত সরকার–ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন পরিচালক পদত্যাগ করেন। এরপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান পরিচালক শাকিল রিজভী, যিনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জেরও পরিচালক।

প্লেসমেন্ট শেয়ারের চাঁদা গ্রহণের সময় মার্চ পর্যন্ত বাড়ানোর আবেদন করলেও গত ২ অক্টোবর শেয়ারগুলো বন্টন করা হয়। তবে সংবাদটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মাধ্যমে শেয়ারধারীদের জানানো হয় ৮ অক্টোবর। যেকোনো সংবেদনশীল তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানানোর বিধান থাকলেও কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কিছু ব্যক্তিকে শেয়ার বিক্রির বাড়তি সুবিধা করে দিতে তা ছয় দিন পরে প্রকাশ করে।

গত ৫ আগস্টের আগে কোম্পানির মালিকানা ও পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি শেখ কবির হোসেন, চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও তাঁর প্রতিনিধি। পরে শেয়ার কিনে মালিকানায় যুক্ত হন শিল্পপতি শওকত আলী চৌধুরী ও শিল্পোদ্যোক্তা নাদের খানের পরিবারের সদস্য ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। তবে বিপুল শেয়ারের মালিকানা থাকলেও তাঁরা কোম্পানির পর্ষদে ছিলেন না।

জানা যায়, কোম্পানির পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই কয়েকজন কর্মকর্তা শেয়ার বণ্টনের এই সিদ্ধান্ত নেন। নতুন বরাদ্দ করা সাড়ে ৪৪ লাখ শেয়ারের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বা ২২ লাখ শেয়ার পেয়েছেন শওকত আলী চৌধুরীর ছেলে জারান আলী চৌধুরী ও মেয়ে সাবাহ সামরিন। এর বাইরে শওকত আলী চৌধুরীর বেনামি প্রতিষ্ঠানও উল্লেখযোগ্য শেয়ার বরাদ্দ পেয়েছে। প্রতিটি শেয়ারের জন্য তাঁরা বিনিয়োগ করেছেন ১১৯ টাকা ৫৩ পয়সা। আর কোম্পানিটির শেয়ারের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২৫৪ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি শেয়ারে মুনাফা হবে ১৩৪ টাকা। বাজারমূল্যে শেয়ার বিক্রি করলে শওকত আলী চৌধুরীর ছেলে ও মেয়ের মুনাফা হয় প্রায় ৩০ কোটি টাকা্ বাড়তি এই মুনাফার সুযোগ করে দিতেই তড়িঘড়ি করে শেয়ার বরাদ্দ দেওয়ার এ সিদ্ধান্ত হয়।

এ বিষয়ে কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত এমডি সৈয়দ মাহমুদ হাসান বলেন, ‘সময় বাড়ানোর আবেদন করে বিএসইসির সাড়া না পেয়ে বিধিমোতাবেক শেয়ার বণ্টন করা হয়েছে। বিশেষ কাউকে সুবিধা দিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিইনি।’

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া রাইট বা প্লেসমেন্টের শেয়ার বণ্টনের বিধান নেই। এনটিসির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এ ক্ষেত্রে কারা এবং কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে, তা তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা হবে।

ন্যাশনাল টির মালিকানার বড় অংশই ছিল সরকারের। সরকারের পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ও সাধারণ বীমা করপোরেশন কোম্পানিটির প্রায় ৪১ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে। বিএসইসির সিদ্ধান্ত ছিল প্লেসমেন্টে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্ধারিত সীমার বেশি শেয়ার দিতে হবে। কিন্তু জুলাই–আগস্টজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পরবর্তী সময়ে সরকার বদলের ফলে সময়মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারের চাঁদা জমা দিতে পারেনি। এ অবস্থায় নতুন শেয়ার ইস্যু হওয়ায় কোম্পানিটিতে সরকারি মালিকানার অংশীদারত্ব কমে মাত্র সাড়ে ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

ট্যাগস

বিশেষ সুবিধা দিতেই প্লেসমেন্ট শেয়ার বন্টনে অনিয়ম

আপডেট সময় ০১:০৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪

বিগত সরকারের আমলের কয়েকজন প্রভাবশালী শেয়ারধারীকে বিশেষ সুবিধা দিতে আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নতুন শেয়ার বণ্টন করে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা তুলে নেওয়োর সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তালিকাভুক্ত ন্যাশনাল টি কোম্পানির বিরুদ্ধে। এর ফলে কয়েক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান বিপুল মুনাফা তুলে নিলেও বঞ্চিত হয় কোম্পানির অন্যতম মালিক সরকারি তিন প্রতিষ্ঠানক।

জানা যায়, কোম্পানিটি মূলধন বাড়াতে প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিদ্যমান শেয়ারধারীদের মধ্যে নতুন ২ কোটি ৩৪ লাখ শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেয়। গত বছরের এপ্রিলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিষয়টি অনুমোদন করে। কোম্পানিাটি প্রতিটি শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১০ টাকা প্রিমিয়ামসহ ১১৯ টাকা ৫৩ পয়সা। একটি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে প্রায় তিনটি নতুন শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত হয় শেয়ারধারীদের মধ্যে। এর মাধ্যমে কোম্পানি ২৮০ কোটি টাকা সংগ্রহের ইচ্ছা ছিল।

এজন্য কোম্পানিটি প্লেসমেন্ট শেয়ারের চাঁদা গ্রহণসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে ১৯ জুন থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হলেও ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাহিত ২৮০ কোটি টাকার বিপরীতে মাত্র ৫৪ কোটি টাকার আবেদন জমা পড়ে। এর ফলে চাঁদা গ্রহণের সময় আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বাড়ানোর আবেদন করা হয়। তবে বিএসইসি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।

এর মধ্যেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে কোম্পানিটির পর্যদ থেকে শেখ কবির হোসেন, নাফিজ সরাফাতসহ বিগত সরকার–ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন পরিচালক পদত্যাগ করেন। এরপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান পরিচালক শাকিল রিজভী, যিনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জেরও পরিচালক।

প্লেসমেন্ট শেয়ারের চাঁদা গ্রহণের সময় মার্চ পর্যন্ত বাড়ানোর আবেদন করলেও গত ২ অক্টোবর শেয়ারগুলো বন্টন করা হয়। তবে সংবাদটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মাধ্যমে শেয়ারধারীদের জানানো হয় ৮ অক্টোবর। যেকোনো সংবেদনশীল তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানানোর বিধান থাকলেও কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কিছু ব্যক্তিকে শেয়ার বিক্রির বাড়তি সুবিধা করে দিতে তা ছয় দিন পরে প্রকাশ করে।

গত ৫ আগস্টের আগে কোম্পানির মালিকানা ও পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি শেখ কবির হোসেন, চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও তাঁর প্রতিনিধি। পরে শেয়ার কিনে মালিকানায় যুক্ত হন শিল্পপতি শওকত আলী চৌধুরী ও শিল্পোদ্যোক্তা নাদের খানের পরিবারের সদস্য ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। তবে বিপুল শেয়ারের মালিকানা থাকলেও তাঁরা কোম্পানির পর্ষদে ছিলেন না।

জানা যায়, কোম্পানির পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই কয়েকজন কর্মকর্তা শেয়ার বণ্টনের এই সিদ্ধান্ত নেন। নতুন বরাদ্দ করা সাড়ে ৪৪ লাখ শেয়ারের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বা ২২ লাখ শেয়ার পেয়েছেন শওকত আলী চৌধুরীর ছেলে জারান আলী চৌধুরী ও মেয়ে সাবাহ সামরিন। এর বাইরে শওকত আলী চৌধুরীর বেনামি প্রতিষ্ঠানও উল্লেখযোগ্য শেয়ার বরাদ্দ পেয়েছে। প্রতিটি শেয়ারের জন্য তাঁরা বিনিয়োগ করেছেন ১১৯ টাকা ৫৩ পয়সা। আর কোম্পানিটির শেয়ারের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২৫৪ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি শেয়ারে মুনাফা হবে ১৩৪ টাকা। বাজারমূল্যে শেয়ার বিক্রি করলে শওকত আলী চৌধুরীর ছেলে ও মেয়ের মুনাফা হয় প্রায় ৩০ কোটি টাকা্ বাড়তি এই মুনাফার সুযোগ করে দিতেই তড়িঘড়ি করে শেয়ার বরাদ্দ দেওয়ার এ সিদ্ধান্ত হয়।

এ বিষয়ে কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত এমডি সৈয়দ মাহমুদ হাসান বলেন, ‘সময় বাড়ানোর আবেদন করে বিএসইসির সাড়া না পেয়ে বিধিমোতাবেক শেয়ার বণ্টন করা হয়েছে। বিশেষ কাউকে সুবিধা দিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিইনি।’

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘পর্ষদের অনুমোদন ছাড়া রাইট বা প্লেসমেন্টের শেয়ার বণ্টনের বিধান নেই। এনটিসির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এ ক্ষেত্রে কারা এবং কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে, তা তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা হবে।

ন্যাশনাল টির মালিকানার বড় অংশই ছিল সরকারের। সরকারের পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ও সাধারণ বীমা করপোরেশন কোম্পানিটির প্রায় ৪১ শতাংশ শেয়ার ধারণ করে। বিএসইসির সিদ্ধান্ত ছিল প্লেসমেন্টে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্ধারিত সীমার বেশি শেয়ার দিতে হবে। কিন্তু জুলাই–আগস্টজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পরবর্তী সময়ে সরকার বদলের ফলে সময়মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারের চাঁদা জমা দিতে পারেনি। এ অবস্থায় নতুন শেয়ার ইস্যু হওয়ায় কোম্পানিটিতে সরকারি মালিকানার অংশীদারত্ব কমে মাত্র সাড়ে ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে।