দেশে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের মধ্যেও ধূমপানের প্রবণতা বাড়ছে। বিশেষ করে শহরকেন্দ্রিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। গত চার বছরে এই প্রবণতা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এতে বাড়ছে নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি।
ধূমপায়ীরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণও করছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে তামাক ব্যবহারের কারণে ৫.৭ শতাংশ নারীর মৃত্যু হচ্ছে। এ অবস্থায় ধূমপান নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইন সংশোধন এবং বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সূত্র মতে, বিশ্বে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমলেও বাংলাদেশে পুরুষের পাশাপাশি নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা বাড়ছে।
নারী ধূমপায়ীর মধ্যে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের ২০২৩ সালের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ বছরের ওপরে মেয়েদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা ১৭.৭ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে ছিল ৭ শতাংশের মতো। অর্থাৎ গত চার বছরে বাংলাদেশে মেয়েদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে সিগারেটের পাশাপাশি ই-সিগারেট বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। তামাকবিরোধী নারী জোটের তথ্যানুযায়ী, দেশে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা চার কোটি ১৩ লাখ। এর মধ্যে ২৩ শতাংশ (দুই কোটি ১৯ লাখ) ধূমপায়ী এবং ২৭.২ শতাংশ (দুই কোটি ৫৯ লাখ) ধোঁয়াবিহীন তামাকে আসক্ত। অর্থাৎ অর্ধেকেরও বেশি তামাক ব্যবহারকারী ধোঁয়াবিহীন তামাকে (জর্দা, গুল) আসক্ত। দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষত নারীদের মধ্যে এই পণ্য ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪.৬ শতাংশ পুরুষ এবং ৫.৭ শতাংশ নারী তামাক ব্যবহারের কারণে মারা যায়।
সরেজমিন ঘুরে নারীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা বাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনের হকার আক্কাস আলী জানান, এই রেলস্টেশনে ১১ বছর ধরে পান, সিগারেটসহ বিভিন্ন তামাকজাতীয় পণ্য বিক্রি করছেন তিনি। নারী যাত্রীরাও অনেক সময় তাঁর কাছ থেকে তামাক পণ্য কেনেন। আগে নারীরা গুল-জর্দা—এ ধরনের তামাক পণ্য কিনলেও এখন অনেকে সিগারেট কিনছেন।
এদিকে ধূমপানের প্রবণতা বাড়ায় নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও ধূমপানের কারণে মুখের ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া তামাক ব্যবহারের কারণে অনেক নারীর গর্ভপাত হচ্ছে, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হচ্ছে কোনো কোনো মায়ের। অন্যদিকে গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ী নারীর বন্ধ্যা হওয়ার আশঙ্কা ৬০ শতাংশের বেশি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ধূমপান এবং তামাক সেবন নারীদের অনেক স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে। তামাকের সঙ্গে গর্ভপাতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ভ্রূণের স্বাস্থ্য সমস্যারও সৃষ্টি করে ধূমপান। এটি নিউরাল টিউব ডিফেক্টের ঝুঁকি বাড়ায়। ফুসফুস ক্যান্সারেরও অন্যতম কারণ ধূমপান। নারীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ধূমপান বন্ধ করার পরবর্তী বছরগুলোয় জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যাচ্ছে।’
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের (গ্যাটস) তথ্য মতে, সিগারেট থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং এতে মিশে থাকা বিষাক্ত উপাদান গর্ভস্থ শিশুর রক্ত সঞ্চালন কমিয়ে দেয়। এতে বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম নিতে পারে। ধূমপায়ী নারীদের ঠোঁট কাটা এবং তালু কাটা সন্তান জন্ম দেওয়ার হার অন্য নারীদের তুলনায় বেশি। মায়েদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব পড়ে শিশুর জন্ম-পরবর্তী সময়েও। এর বিরূপ প্রভাবে শিশু স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন, অমনোযোগী ও অতিচঞ্চল হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিশুদের আচরণগত সমস্যা বা লেখাপড়া করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের এপিডেমিওলজি ও গবেষণা বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. সোহেল রেজা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীসহ শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নারীরা শুধু ধূমপানের কারণেই নয়, তামাক উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতসহ অন্যান্য কাজে নারীসহ শিশুদের সম্পৃক্ত করায় তারা স্বাস্থ্যক্ষতিসহ বিভিন্ন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই তামাকের ক্ষতিকর দিক থেকে নারীদের রক্ষায় পদপেক্ষ নেওয়া প্রয়োজন।’
তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নে বিদ্যমান আইন সংশোধন করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোটের অন্যতম সংগঠক অ্যাডভোকেট মাহবুবুল আলম। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘শুধু আইনের দুর্বলতার কারণে ধূমপান না করেও কর্মক্ষেত্রে ৪২.৭ শতাংশ, গণপরিবহনে ৪৪ শতাংশ এবং বাড়িতে ৩৭ শতাংশ নারী-পুরুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। এসব সমস্যা সমাধানে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা জরুরি। আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তামাক কম্পানিগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির আড়ালে তামাক পণ্যে তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করছে। এ কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ও তা বাস্তবায়নের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি।’