পোশাকে আরবি লেখা থাকায় পাকিস্তানে জনগণের রোষের মুখে পড়েছেন এক নারী। রোববার দেশটির পাঞ্জাব প্রদেশের কয়েকটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে দেখা গেছে, একটি রেস্তোরাঁর এক কোণে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে আছেন এক নারী। আর তার সামনে বিক্ষুব্ধ জনতার ভিড়।
এদের মধ্যে কেউ কেউ চিৎকার করে তার পোশাক খুলে ফেলতে বলছেন। কেউ কেউ বলছেন, যারা ব্লাসফেমি (ধর্ম অবমাননা) করে তাদের শিরশ্ছেদ করা উচিত। পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোরে ওই রেস্তোরাঁয় আসা নারীটির পোশাকে আরবি ক্যালিগ্রাফি ছিল। স্থানীয়দের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, সেখানে কোরআনের আয়াত লেখা।
ফলে, অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক বিক্ষুব্ধ লোক জড়ো হয়ে যান সেখানে। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। প্রায় ৩০০ লোক সেখানে ভিড় করেছিল বলে বিবিসিকে জানায় পুলিশ। রোববার স্থানীয় সময় দুপুরে তারা এ ব্যাপারে একটি ফোনকল পান।
সহকারী পুলিশ সুপার সাইয়েদা শেহরবানোর নেতৃত্বে একটি দল ছুটে আসে ঘটনাস্থলে। তারা দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেন। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, শেহরবানো রেস্তোরাঁর প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে ওঠা জনতার মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে বলছেন তাদের।
তিনি বলেন, কেউ আসলে জানত না শার্টে কি লেখা ছিল। পোশাকটিতে ক্যালিগ্রাফি করা আরবি হরফে হালওয়া শব্দটি মুদ্রিত ছিল। আরবি ভাষায় ‘হালওয়া’ শব্দের অর্থ মিষ্টি। ‘সুন্দর’ অর্থেও ব্যবহৃত হয় শব্দটি। কিন্তু স্থানীয়রা সেটিকে ভুল করে কোরানের আয়াত ভেবেছিল।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সবচেয়ে দুঃসাধ্য কাজ ছিলো ওই নারীকে নিরাপদে ওই জায়গা থেকে বের করে আনা।ভুক্তভোগীকে একটি বোরকার সঙ্গে হিজাবের মতো করে মাথা ও মুখমণ্ডল ঢেকে বের করে নিয়ে আসেন তিনি। এ সময় তাদের বেষ্টন করেছিলেন পুলিশ সদস্যরা। উত্তেজনামুখর পরিস্থিতিতে একরকম দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তারা।
কট্টরপন্থী দল তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তানের (টিএলপি) সমর্থকরা ভিড়ের মধ্যে ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।শেহরবানো জানান, তাকে সমবেত লোকজনের সাথে রীতিমত আলোচনা করতে হয়েছিল।
আমরা তাদের বলি, এই নারীকে আমাদের সাথে করে নিয়ে যাবো, তার কর্মকাণ্ড আইনিভাবে আমলে নেওয়া হবে এবং দেশের আইন অনুসারে যদি তিনি কোনো অপরাধ করে থাকেন তবে অবশ্যই তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে।
তাকে একটি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বেশ কয়েকজন আলেমের মতামত নেওয়া হয়। তারা নিশ্চিত করেন যে, পোশাকের লেখাটিতে আরবি ক্যালিগ্রাফিই ছিল, কোরআনের আয়াত নয়।
তখন পুলিশ আলেমদের একটি ভিডিও রেকর্ড করতে বলেন। ভিডিওতে তাদের মতামত এবং নারীটি যে নির্দোষ সেটি উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তানে ব্লাসফেমির শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এমনকি মামলার বিচারের আগেই পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনাও আছে।
অবশ্য ওই নারীও ক্ষমা চেয়েছেন। নিজেকে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান দাবি করে তিনি বলেন, আমার তেমন কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। ভুল বোঝাবুঝির কারণে এটা ঘটেছে। তারপরও যা ঘটেছে তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী এবং নিশ্চিত করে বলছি আর কখনো এমন হবে না।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিনি কেনাকাটা করতে লাহোরে এসেছিলেন এবং দ্রুতই শহর ছেড়ে চলে গেছেন। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা তাহির মাহমুদ আশরাফি সামাজিক মাধ্যমে এক পোস্টে লিখেছেন, ওই নারীর নয়, ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল ভিড়ের মধ্যে থাকা পুরুষদের।
এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন সাইয়েদা শেহরবানো। তিনি বলেন, আমি যদি উচু গলায় কথা না বলতাম এবং জনতাকে আস্থায় নিতে না পারতাম যে আমরা একটা কিছু করব, তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারতো… স্রষ্টাকে ধন্যবাদ।
এই সহকারী পুলিশ সুপার ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। পাঞ্জাবের পুলিশ প্রধান তার সাহসিকতার জন্য তাকে পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়েছেন।
গত বছরের আগস্টে কুরআন অবমাননার অভিযোগে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় শহর জারানওয়ালায় খ্রিস্টানদের গির্জা ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের শান্তি ও বিচার বিষয়ক জাতীয় কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৭৭৬ জন মুসলিম, ৫০৫ জন আহমাদি, ২২৯ জন খ্রিস্টান এবং ৩০ জন হিন্দুকে ব্লাসফেমি আইনের আওতায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। এসব মামলার বড় একটা অংশই কোরআন অপবিত্র করার অভিযোগে করা হয়েছে। পাকিস্তানের মানুষের একটা বড় অংশ এই আইনের সমর্থন করেন।