ঢাকা , শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সরকার কঠোর হলেও পিছু হটছে না আন্দোলনকারীরা

  • ডেস্ক :
  • আপডেট সময় ০১:০৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ জুলাই ২০২৪
  • 22

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘিরে তীব্র যানজটের দুর্বিষহ জনদুর্ভোগ এবং আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা এড়াতে সরকার এবার হার্ডলাইনে নামলেও পিছু হটছে না আন্দোলনকারীরা। বরং এ ইস্যুতে আন্দোলন কর্মসূচি আরও জোরাল করে সরকারকে কোটা সংস্কারে বাধ্য করার তোড়জোড় চালাচ্ছে। দাবি আদায় না হলে সবাইকে নিয়ে গণ-আন্দোলনে নামারও হুমকি দিয়েছে তারা।

এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটা সংস্কার দাবিতে রোববার রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান এবং গণপদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলনে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে নাম উল্লেখ না করে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় পুলিশের করা মামলা প্রত্যাহারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়।

তবে আন্দোলনকারীদের এ হুঁশিয়ারিকে ততটা পাত্তা দিচ্ছে না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধŸতনরা। তাদের ভাষ্য, আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা, জনদুর্ভোগ বা নাশকতা ঘটানোর আভাস পেয়েছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের জানমাল রক্ষা এবং দুর্ভোগ নিরসনে অ্যাকশনে নামার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কোথাও কোনো তাণ্ডব চালানোর চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করা হবে। এজন্য আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাঠ পর্যায়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবি ও অনেক বক্তব্য সংবিধানের এবং সাংবিধানিক রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি বিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আন্দোলন সংবিধানের বিরুদ্ধে বা আদালতের বিরুদ্ধে গেলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে বলে হুঁশিয়ার করেন তিনি।

অন্যদিকে আন্দোলনের নামে দেশ অস্থিতিশীলের চেষ্টা করলে ফলাফল ভালো হবে না বলে হুঁশিয়ার করেছে ছাত্রলীগ।

শনিবার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, যারা শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে ভর করে ষড়যন্ত্র করে এ দেশের অগ্রযাত্রাকে বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে, সেই ধরনের লোকদের এ আন্দোলনে সম্পৃক্ততা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কেউ দেশের শান্ত পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে ফলাফল ভালো হবে না।

তবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সরকার হার্ডলাইনে নামলেও এ ইস্যুতে সমাধানের পথও খুঁজছে সরকার। তবে সংস্কারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ যাতে এ নিয়ে আবার আন্দোলনে না নামে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যাতে কৌশলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তুলতে না পারে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ইস্যুটি সমাধানের সহজ সমীকরণ এতদিন সরকারের হাতে না থাকলেও গত বৃহস্পতিবার কোটা নিয়ে হাইকোর্টের সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশের পর সেই পথের দিশা মিলেছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার এখন সব কুল রক্ষা করে সুষ্ঠু দ্রুত সমাধানের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছে। তবে এর আগেই কারও উসকানির ফাঁদে পা দিয়ে আন্দোলন কর্মসূচির নামে জনদূর্ভোগ, বিশৃঙ্খলা ও নাশকতার অপচেষ্টা চালালে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ কঠোর ভূমিকা পালন করবে।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সূত্র বলছে, কোটাব্যবস্থা সংস্কার করে কোন কোটা কিভাবে কমানো যেতে পারে, তা নিয়ে সরকারের ভেতরে আলোচনা শুরু হয়েছে। সরকার চাইছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান দিতে। অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দফায় দফায় আলাপ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী চীন থেকে দেশে ফেরার পরও সরকারের ওপর মহলে আলাপ হয়েছে বিষয়টি নিয়ে।

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, কোর্টের পর্যবেক্ষণগুলো সরকার আমলে নেবে। এখন এ-সংক্রান্ত বিচার চলমান আছে। তাই ভবিষ্যতে সরকারের কী করণীয়, তা আদালতের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিবেচনা করা যাবে। বিচার বিভাগের অনেক পর্যবেক্ষণ নির্বাহী বিভাগ গ্রহণ করে এবং বাস্তবায়ন করে।

সরকারের একাধিক মন্ত্রী জানিয়েছেন, কোটা বহাল থাকার সময় ও বাতিলের পরে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের হার পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদনও তৈরি করা হয়েছে। একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির বিষয়ে আলোচনা চলছে। যদিও ঠিক কবে নাগাদ সংস্কার প্রস্তাব তৈরি সম্পন্ন হবে তা তারা জানাতে পারেননি।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভাষ্য, কোটাবিরোধী আন্দোলনটিকে যৌক্তিক এবং স্পর্শকতার হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে এতোদিন কোনো ধরনের বাধা দেয়নি সরকার। এমনকি শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে সব ধরনের আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বের ত্রুটি করেনি। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদেরও সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া দরকার। পাশাপাশি জনদুর্ভোগের বিষয়টিও মাথায় নিতে হবে। ফলে আর কোনো সড়ক বা রেলপথ অবরোধ করে কর্মসূচি নেওয়া হবে না- এমনটাই প্রত্যাশা সরকারের। আন্দোলনকারীরা ধৈর্য ধরলে এ বিষয়টির দ্রুত সমাধান হবে বলেও মনে করেন তারা।

তবে সরকার কোটা সংস্কারের উদ্যোগের কথা বললেও খুব শিগগিরই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না বলে মনে করেন অনেকেই। এর কারণ হিসেবে তারা সরকার আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলন বিষয়টি এমনিতেই জটিলতর রূপ নিয়েছে। এটি আরও বাড়লে দেশ ভয়াবহভাবে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। তাই বিষয়টির দ্রুত সমাধান করা উচিত। দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয় করা জরুরি। শিক্ষার্থী এবং সরকার দুই পক্ষেরই যৌক্তিক সমাধানে আসতে হবে। আস্থার সংকট দূর হলে শিক্ষার্থীদের অন্দোলনও বন্ধ হবে, জনগণের ভোগান্তিও দূর হবে। যদি কোটা সংস্কারের জন্য একটি কমিটি করার ঘোষণাও দেওয়া হয় এতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের উত্তাপ অনেকটাই কমবে। এমনকি আন্দোলন পুরোপুরি থেমেও যেতে পারে।

এদিকে শিক্ষাবিদরা অনেকেই মনে করেন, কোটা সংস্কার নিয়ে দেশে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই দ্রুত এ সংকটের সমাধান জরুরি। সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। সরকার এখন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে কোটার সংস্কার করতে পারে। অবিলম্বে কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করা উচিত সরকারের। আর সব মিলিয়ে ২০ শতাংশের বেশি কোটা রাখা কোনোভাবেই উচিত হবে না।

তাদের আশা, আন্দোলনকারীদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে এর সমাধান পাওয়া যাবে। আন্দোলনকারীরাও যেহেতু কোটাপদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল না করে সংস্কারের কথা বলছে, তাই এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা হতেই পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার ও আন্দোলনকারী- দুই পক্ষকেই জেদাজেদির পথ পরিহার করে সমঝোতার পথ খুঁজতে হবে।

যদিও শিক্ষাবিদরা কেউ কেউ মনে করেন, শিক্ষার্থীরা যে বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনে রয়েছে সেটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তাই এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করা উচিত। আপাতত আন্দোলনে গিয়ে এর সমাধান মিলবে না। বরং আন্দোলন কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এতে জনক্ষোভ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া আন্দোলনে দুষ্টুচক্র ঢুকে পড়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। পুলিশ এসব ঘটনায় মামলা দায়ের করতে শুরু করেছে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, কোটা সংস্কারের বিষয়টি প্রশাসনিক। ফলে সমাধানের দায়িত্ব সরকারের। এখন শিক্ষার্থী ও সরকার উভয়েরই সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন।

প্রসঙ্গত, মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রয়াত আকবর আলি খান ও সাবেক সচিব কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ২০০৮ সালে বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে কোটাব্যবস্থার ওপর গবেষণা করে তা কমানোর সুপারিশ করেছিলেন। ওই গবেষণায় বলা হয়, অগ্রাধিকার কোটা কোনোভাবেই মেধা কোটার চেয়ে বেশি হতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) উদ্যোগে ওই গবেষণা করা হয়েছিল। যদিও সেই গবেষণার সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।

প্রায় ছয় বছর আগে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সব কোটা বাতিল করে সরকার। বাতিলের আগে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে যে কমিটি করা হয়েছিল, তারা এই পাঁচ গ্রেডে কোটা বাতিলের সুপারিশ করেছিল।

ওই কমিটি কোটা বাতিলের ফলে কোটার সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রভাব সম্পর্কে পর্যালোচনা করে পাওয়া পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ারও সুপারিশ করেছিল। অর্থাৎ ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কোটা পর্যালোচনা করে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।

২০১৮ সালের অক্টোবরে সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের সব কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সরকার। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, কোটা বাতিলের আগে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে কমিটি করেছিল সরকার। ওই কমিটি তিনটি সুপারিশ করে। প্রথম সুপারিশ ছিল নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া। দ্বিতীয় সুপারিশ ছিল, এসব গ্রেডে বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি বাতিল করা এবং তৃতীয় সুপারিশ ছিল, কোটা বাতিলের ফলে কোটার সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রভাব সম্পর্কে নির্দিষ্ট সময় পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া; অর্থাৎ প্রথম দুটি সুপারিশের মূল কথা হলো, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে কোটা থাকবে না। এসব পদে নিয়োগ হবে সরাসরি মেধার ভিত্তিতে। আর ওই কমিটির তৃতীয় সুপারিশটির ব্যাখ্যা হলো, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যদি কোনো পরিবর্তন দেখা দেয় যে কোটা অপরিহার্য, তবে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারবে। বিষয়টি অনগ্রসর সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

শেষের সুপারিশের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে ওই কমিটির প্রধান সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, সেই সুপারিশের ব্যাখ্যা হলো, কোটা বাতিলের পর কী প্রভাব পড়েছে, সেটি পর্যালোচনা করে প্রয়োজন অনুযায়ী সমন্বয় করা।

ট্যাগস

সরকার কঠোর হলেও পিছু হটছে না আন্দোলনকারীরা

আপডেট সময় ০১:০৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ জুলাই ২০২৪

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘিরে তীব্র যানজটের দুর্বিষহ জনদুর্ভোগ এবং আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা এড়াতে সরকার এবার হার্ডলাইনে নামলেও পিছু হটছে না আন্দোলনকারীরা। বরং এ ইস্যুতে আন্দোলন কর্মসূচি আরও জোরাল করে সরকারকে কোটা সংস্কারে বাধ্য করার তোড়জোড় চালাচ্ছে। দাবি আদায় না হলে সবাইকে নিয়ে গণ-আন্দোলনে নামারও হুমকি দিয়েছে তারা।

এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে কোটা সংস্কার দাবিতে রোববার রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান এবং গণপদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলনে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে নাম উল্লেখ না করে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় পুলিশের করা মামলা প্রত্যাহারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়।

তবে আন্দোলনকারীদের এ হুঁশিয়ারিকে ততটা পাত্তা দিচ্ছে না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধŸতনরা। তাদের ভাষ্য, আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা, জনদুর্ভোগ বা নাশকতা ঘটানোর আভাস পেয়েছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের জানমাল রক্ষা এবং দুর্ভোগ নিরসনে অ্যাকশনে নামার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কোথাও কোনো তাণ্ডব চালানোর চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করা হবে। এজন্য আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মাঠ পর্যায়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবি ও অনেক বক্তব্য সংবিধানের এবং সাংবিধানিক রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি বিরোধী বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আন্দোলন সংবিধানের বিরুদ্ধে বা আদালতের বিরুদ্ধে গেলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে বলে হুঁশিয়ার করেন তিনি।

অন্যদিকে আন্দোলনের নামে দেশ অস্থিতিশীলের চেষ্টা করলে ফলাফল ভালো হবে না বলে হুঁশিয়ার করেছে ছাত্রলীগ।

শনিবার সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, যারা শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে ভর করে ষড়যন্ত্র করে এ দেশের অগ্রযাত্রাকে বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে, সেই ধরনের লোকদের এ আন্দোলনে সম্পৃক্ততা আমাদের উদ্বিগ্ন করে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কেউ দেশের শান্ত পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে ফলাফল ভালো হবে না।

তবে সরকারের নীতিনির্ধারকদের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সরকার হার্ডলাইনে নামলেও এ ইস্যুতে সমাধানের পথও খুঁজছে সরকার। তবে সংস্কারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ যাতে এ নিয়ে আবার আন্দোলনে না নামে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যাতে কৌশলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে তুলতে না পারে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ইস্যুটি সমাধানের সহজ সমীকরণ এতদিন সরকারের হাতে না থাকলেও গত বৃহস্পতিবার কোটা নিয়ে হাইকোর্টের সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশের পর সেই পথের দিশা মিলেছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার এখন সব কুল রক্ষা করে সুষ্ঠু দ্রুত সমাধানের দিকে এগোনোর চেষ্টা করছে। তবে এর আগেই কারও উসকানির ফাঁদে পা দিয়ে আন্দোলন কর্মসূচির নামে জনদূর্ভোগ, বিশৃঙ্খলা ও নাশকতার অপচেষ্টা চালালে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ কঠোর ভূমিকা পালন করবে।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সূত্র বলছে, কোটাব্যবস্থা সংস্কার করে কোন কোটা কিভাবে কমানো যেতে পারে, তা নিয়ে সরকারের ভেতরে আলোচনা শুরু হয়েছে। সরকার চাইছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান দিতে। অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দফায় দফায় আলাপ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী চীন থেকে দেশে ফেরার পরও সরকারের ওপর মহলে আলাপ হয়েছে বিষয়টি নিয়ে।

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, কোর্টের পর্যবেক্ষণগুলো সরকার আমলে নেবে। এখন এ-সংক্রান্ত বিচার চলমান আছে। তাই ভবিষ্যতে সরকারের কী করণীয়, তা আদালতের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিবেচনা করা যাবে। বিচার বিভাগের অনেক পর্যবেক্ষণ নির্বাহী বিভাগ গ্রহণ করে এবং বাস্তবায়ন করে।

সরকারের একাধিক মন্ত্রী জানিয়েছেন, কোটা বহাল থাকার সময় ও বাতিলের পরে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের হার পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদনও তৈরি করা হয়েছে। একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির বিষয়ে আলোচনা চলছে। যদিও ঠিক কবে নাগাদ সংস্কার প্রস্তাব তৈরি সম্পন্ন হবে তা তারা জানাতে পারেননি।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভাষ্য, কোটাবিরোধী আন্দোলনটিকে যৌক্তিক এবং স্পর্শকতার হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে এতোদিন কোনো ধরনের বাধা দেয়নি সরকার। এমনকি শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে সব ধরনের আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বের ত্রুটি করেনি। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদেরও সরকারের আন্তরিকতার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া দরকার। পাশাপাশি জনদুর্ভোগের বিষয়টিও মাথায় নিতে হবে। ফলে আর কোনো সড়ক বা রেলপথ অবরোধ করে কর্মসূচি নেওয়া হবে না- এমনটাই প্রত্যাশা সরকারের। আন্দোলনকারীরা ধৈর্য ধরলে এ বিষয়টির দ্রুত সমাধান হবে বলেও মনে করেন তারা।

তবে সরকার কোটা সংস্কারের উদ্যোগের কথা বললেও খুব শিগগিরই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না বলে মনে করেন অনেকেই। এর কারণ হিসেবে তারা সরকার আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকার বিষয়টি তুলে ধরেন। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলন বিষয়টি এমনিতেই জটিলতর রূপ নিয়েছে। এটি আরও বাড়লে দেশ ভয়াবহভাবে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। তাই বিষয়টির দ্রুত সমাধান করা উচিত। দুই পক্ষের মধ্যে সমন্বয় করা জরুরি। শিক্ষার্থী এবং সরকার দুই পক্ষেরই যৌক্তিক সমাধানে আসতে হবে। আস্থার সংকট দূর হলে শিক্ষার্থীদের অন্দোলনও বন্ধ হবে, জনগণের ভোগান্তিও দূর হবে। যদি কোটা সংস্কারের জন্য একটি কমিটি করার ঘোষণাও দেওয়া হয় এতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের উত্তাপ অনেকটাই কমবে। এমনকি আন্দোলন পুরোপুরি থেমেও যেতে পারে।

এদিকে শিক্ষাবিদরা অনেকেই মনে করেন, কোটা সংস্কার নিয়ে দেশে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই দ্রুত এ সংকটের সমাধান জরুরি। সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। সরকার এখন একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে কোটার সংস্কার করতে পারে। অবিলম্বে কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করা উচিত সরকারের। আর সব মিলিয়ে ২০ শতাংশের বেশি কোটা রাখা কোনোভাবেই উচিত হবে না।

তাদের আশা, আন্দোলনকারীদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে এর সমাধান পাওয়া যাবে। আন্দোলনকারীরাও যেহেতু কোটাপদ্ধতি পুরোপুরি বাতিল না করে সংস্কারের কথা বলছে, তাই এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা হতেই পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার ও আন্দোলনকারী- দুই পক্ষকেই জেদাজেদির পথ পরিহার করে সমঝোতার পথ খুঁজতে হবে।

যদিও শিক্ষাবিদরা কেউ কেউ মনে করেন, শিক্ষার্থীরা যে বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনে রয়েছে সেটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তাই এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করা উচিত। আপাতত আন্দোলনে গিয়ে এর সমাধান মিলবে না। বরং আন্দোলন কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এতে জনক্ষোভ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া আন্দোলনে দুষ্টুচক্র ঢুকে পড়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। পুলিশ এসব ঘটনায় মামলা দায়ের করতে শুরু করেছে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, কোটা সংস্কারের বিষয়টি প্রশাসনিক। ফলে সমাধানের দায়িত্ব সরকারের। এখন শিক্ষার্থী ও সরকার উভয়েরই সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন।

প্রসঙ্গত, মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রয়াত আকবর আলি খান ও সাবেক সচিব কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ ২০০৮ সালে বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে কোটাব্যবস্থার ওপর গবেষণা করে তা কমানোর সুপারিশ করেছিলেন। ওই গবেষণায় বলা হয়, অগ্রাধিকার কোটা কোনোভাবেই মেধা কোটার চেয়ে বেশি হতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) উদ্যোগে ওই গবেষণা করা হয়েছিল। যদিও সেই গবেষণার সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।

প্রায় ছয় বছর আগে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সব কোটা বাতিল করে সরকার। বাতিলের আগে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে যে কমিটি করা হয়েছিল, তারা এই পাঁচ গ্রেডে কোটা বাতিলের সুপারিশ করেছিল।

ওই কমিটি কোটা বাতিলের ফলে কোটার সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রভাব সম্পর্কে পর্যালোচনা করে পাওয়া পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ারও সুপারিশ করেছিল। অর্থাৎ ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কোটা পর্যালোচনা করে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।

২০১৮ সালের অক্টোবরে সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের সব কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সরকার। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, কোটা বাতিলের আগে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে কমিটি করেছিল সরকার। ওই কমিটি তিনটি সুপারিশ করে। প্রথম সুপারিশ ছিল নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া। দ্বিতীয় সুপারিশ ছিল, এসব গ্রেডে বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি বাতিল করা এবং তৃতীয় সুপারিশ ছিল, কোটা বাতিলের ফলে কোটার সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রভাব সম্পর্কে নির্দিষ্ট সময় পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া; অর্থাৎ প্রথম দুটি সুপারিশের মূল কথা হলো, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে কোটা থাকবে না। এসব পদে নিয়োগ হবে সরাসরি মেধার ভিত্তিতে। আর ওই কমিটির তৃতীয় সুপারিশটির ব্যাখ্যা হলো, সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যদি কোনো পরিবর্তন দেখা দেয় যে কোটা অপরিহার্য, তবে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারবে। বিষয়টি অনগ্রসর সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

শেষের সুপারিশের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে ওই কমিটির প্রধান সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, সেই সুপারিশের ব্যাখ্যা হলো, কোটা বাতিলের পর কী প্রভাব পড়েছে, সেটি পর্যালোচনা করে প্রয়োজন অনুযায়ী সমন্বয় করা।