একাত্তর ও নব্বইয়ের পর আরও এক গণ জোয়ার দেখল বাংলাদেশ। ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে হলো সরকার পতন। বর্তমানে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত রাষ্ট্রের কাঠামো ব্যবস্থা। এই সমস্যা সমাধানে তারুণ্যের চিন্তাভাবনাই তৈরি করতে পারে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা। দেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের রাষ্ট্র মেরামতের আগ্রহ ও দেশপ্রেমের আকুতি চোখে পড়ার মতো। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে নতুন বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চায় বিদেশে পড়ুয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা, তা তুলে ধরেছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
সোহীনি নদী শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
আমরা এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে প্রতিটি মানুষ তার মেধা, শ্রম এবং সততার মূল্যায়ন পাবে। একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চাই, যেখানে কেউ তার যোগ্যতার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে না। বিশেষ করে শিক্ষাখাতকে দুর্নীতি থেকে মুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। যাতে দেশের প্রতিটি মেধাবী শিক্ষার্থী তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী সুযোগ পায় এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের স্বপ্নকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গুরুতর অপরাধের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে। এটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার এক কঠিন চিত্র। এমন ঘটনা দেশের তরুণ মেধাবীদের হতাশ করে এবং অনেকেই বাধ্য হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, যেখানে তাদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হয়। এই প্রবণতা দেশের জন্য ক্ষতিকর। কারণ এতে দেশ মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। আমরা চাই, বিদেশে যারা পড়াশোনা করছি তাদের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাবে। কিন্তু এজন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশের বাইরে থেকেও দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত-দেশের উন্নয়নে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করা, দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা। পাশাপাশি একটি উন্নত, সুশৃঙ্খল ও সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ে তোলা। এই স্বপ্ন পূরণ করতে হলে, সমাজের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু তখনই আমরা সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবো।
মো: রনি মিয়া
শিক্ষার্থী, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখ, জার্মানি
দেশের সার্বিক দিক বিবেচনায় একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। যেখানে দেশের সব জনগণ ন্যায় বিচারের অধিকার পাবে। সেই সঙ্গে দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রম হবে শতভাগ দুর্নীতি মুক্ত। যার প্রধান লক্ষ্য হবে জগণের সেবা নিশ্চিত করা। যদি শিক্ষা হয় জাতির মেরুদণ্ড তাহলে শিক্ষার মান উন্নয়নে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এবং স্বাধীন। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও বেশি গবেষণায় মনোযোগী হতে হবে। যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিভার সঠিক ব্যবহার করে বিভিন্ন উদ্ভাবনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। দেশের চিকিৎসা খাতে আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে সব সাধারণ নাগরিকের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের সর্বাধিক জনগণ নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তাই সরকারি হাসপাতালগুলোতে শতভাগ ডাক্তারের উপস্থিত নিশ্চিত করে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করে রাষ্ট্রের খাদ্যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আগামীর বাংলাদেশে সবার মত প্রকাশের সুযোগ থাকতে হবে।
তুষার তন্ময়
শিক্ষার্থী, সেইনাওকি ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্সেস, ফিনল্যান্ড
আগামীর বাংলাদেশকে দেখতে চাই দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও বৈষম্য মুক্ত সমাজ হিসেবে। যেখানে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে নারীর ক্ষমতায়ন, সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং শিশুদের সুরক্ষা প্রাধান্য পাবে। শিশুশ্রম পুরোপুরিভাবে বন্ধ হবে। আগামীর বাংলাদেশে আইনের অনুশাসন ও সমতা আনতে হবে। বিচারব্যবস্থা হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। তৃতীয় পক্ষ কিংবা ক্ষমতাসীন কারো কোনো প্রকার হাত রাখা যাবে না বিচারিক কার্যক্রমে। আইন সবার জন্য সমান। এতে কারো প্রতি বৈষম্য কিংবা পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না। দেশের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ও কর্মসংস্থান সবার জন্য নিশ্চিত থাকবে। আগামীর বাংলাদেশে মানুষের মত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যেন মানুষ নির্ভয়ে তার চিন্তা, মতামত এবং অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে, এমনকি তা সরকারি বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গেলেও। আগামীর বাংলাদেশে মানুষকে মানুষ ভাবতে হবে। যে বাংলাদেশে মানুষ দুর্নীতি ও দারিদ্র্যকে পিছনে ফেলে মাথা উঁচু করে বলতে পারে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং সবার জন্য নিরাপদ দেশের নাগরিক।
সায়মা আক্তার মিলি
শিক্ষার্থী, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মিউনিখ,জার্মানি
আগামীতে এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই যেখানে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে বৈশ্বিক মান অর্জিত হবে। প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত থাকবে। দুর্নীতিমুক্ত, পরিবেশবান্ধব ও সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে। যেখানে ন্যায়বিচার, সমান অধিকার এবং কথা বলার স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। জনগণ নির্ভয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারবে। উন্নত ও নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সহজ, দ্রুত ও নিরাপদ হবে। এতে জনগণ সড়ক নিরাপত্তা ও ট্রাফিক নিয়ম সম্পর্কে সচেতন হয়ে দুর্ঘটনার হার কমাবে। যুবসমাজ তাদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান অর্জন করবে। এমন একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও সম্মানজনক লাল-সবুজের বাংলাদেশ আমার স্বপ্ন। যেখানে প্রতিটি নাগরিক গর্বিত বোধ করবে এবং জাতি হিসেবে বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।
জাহিদ হাসান জনী
শিক্ষার্থী, আল্টো ইউনিভার্সিটি, ফিনল্যান্ড
ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে বিগত সরকারের পতন হয়েছে। বিদেশের মাটিতে থাকলেও আমাদের মনটা দেশেই পড়ে থাকে। দেশ ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকি। চলছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রথমেই নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠ নির্বাচন দেখতে চাই। নতুন বাংলাদেশে বিচার ও আইন বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে। দেশের প্রায় প্রতিটি খাতেই দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভঙ্গুর অবস্থা। এসব খাতগুলো শতভাগ মেরামত করতে হবে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষকে নিয়ে হয়রানি করা হয়, এসব বন্ধ করতে হবে। তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে। দুর্নীতি ও ঘুষের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যে কোনো চাকরির পরীক্ষায় মেধাভিত্তিক নিয়োগ হবে। ক্যম্পাসগুলোতে দলীয় রাজনীতি বন্ধ থাকবে। রাজনৈতিক ও দলীয় প্রভাবপ্রথা ভেঙে যোগ্য ব্যক্তিকে তার আসনে স্থান দিতে হবে। পুলিশ প্রসাশন তার নিজস্ব আইনের গতিতে চলবে। এখানে কারো হস্তক্ষেপ চলবে না। দেশের শিক্ষাখাতে গবেষণা ও কর্মমুখী করে গড়ে তুলতে হবে। ভবিষ্যতের স্বপ্নের বাংলাদেশে মানুষের বাক-স্বাধীনতা থাকবে। সবাই তাদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে। সর্বোপরি, আগামীর বাংলাদেশ গঠনে তরুণ নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে।